মাথা ভর্তি ঝাঁকরা বাবরি চুল, মুখ জুড়ে ছোট চাপ দাঁড়ি। কোটপ্যান্ট পরা লোকদের মধ্যে পাঞ্জাবী পরা লোকটিকে বেশ ব্যতিক্রম মনে হচ্ছে। পোশাকে ও চালচলনেও উন্নত রুচির পরিচয় বহন করছে। দেখতে খুব আকর্ষণীয় লাগছে। মনে হচ্ছে সে যেন প্রকৃতির সৃষ্টি কোন শিল্প। যা নিখুঁত ভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। দুই তিন বার তার চোখে চোখ পরল। চোখ নামিয়ে অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিলাম। ভাবলাম কী করছি এসব? আমি বিবাহিতা নারী। বিবাহিতা নারীদের সুন্দর সব কিছু দেখার অধিকার থাকলেও সুন্দর পুরুষ দেখে অনুভূতি সৃষ্টি হওয়া মোটেও সমীচীন নয়। তথাপি চোখ ফিরাতে পারলাম না। সরাসরি না দেখে আড় চোখে আরও কয়েকবার তাকিয়ে দেখলাম তাঁকে। লোকটি হয়তো সেটা বুঝতে পারলো, কারন কেন যেন আমার মনে হোল লোকটিও আমাকেও ঘুরে ফিরেই দেখছে। তবে তা লুকিয়ে বা আড় চোখে নয়। নির্লিপ্ত ভাবেই দেখছে। হঠাৎ লোকটি আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। ভরাট কণ্ঠে বলল
-কেমন আছো?
-হতভম্ব হয়ে গেলাম, তুমি করে বলছে কেন? ভাবছি তুমি করে বলছে যেহেতু হবে হয়তো আমার ঘনিষ্ঠ কেউ। খুব পরিচিত যদি কেউ হয় তাহলে তো অবশ্যই আমারও তাঁকে চেনার কথা। কিন্তু আমি কেন তাঁকে চিন্তে পারছি না।? আমাকেই বা উনি কীভাবে চেনেন?
-বললে না কেমন আছো?
-জি ভালো।
-ভাবছ আমি তোমাকে কীভাবে চিনি? আমাকেও তো চিনতে পাচ্ছ না, তাইনা?
-হুম ঠিক তাই। ঠিক মনে করতে পারছি না…।
-নাম বললে চিনবে? নাম বললে তো চিনবে না বরং একটা কাজ করি তুমি যাতে আমাকে চেন সেটাই বলি।
-প্লিজ।
-বেয়ারিং চিঠির লেখক, এক সময় তোমাকে আমি অনেক বেয়ারিং চিঠি লিখতাম।
এক ঝটকায় চলে গেলাম ক্লাস এইটের পড়া চৌদ্দ বছর বয়সে। উনিই সেই লোক! যিনি আমাকে বেয়ারিং চিঠি লিখত? আমার টিফিনের টাকা থেকে জমানো দুই টাকা খরচ করে তাঁর পাঠানো বেয়ারিং চিঠির মুল্য পরিশোধ করতাম। নাম ঠিকানা বিহীন ভালোবাসায় ভরপুর এক একটি চিঠি লিখতেন।
-তোমাকে কখনই সামনাসামনি ভালোবাসার কথা বলতে পারিনি। একটা সময় প্রচণ্ড ভালোবাসতাম তোমাকে।
-এসব কথা এখন অপ্রাসঙ্গিক নয় কি? আমি বিবাহিতা আমার স্বামী…
-তোমার স্বামী শিমুল আমার পরিচিত। আমার আমন্ত্রণেই তোমরা এখানে এসেছ।
-কিন্তু আপনি?
-ঐযে বললাম বেয়ারিং চিঠির লেখক। আমার চোখে তুমি একটুও বদলাওনি। তেমনই আছো। আজও তোমাকে আমি তেমনই ভালোবাসি। আগে যেমন বাসতাম। স্থান কাল পরিবর্তনের সাথে ভালোবাসার মান পাল্টেছে শুধু। মিলনে ভালোবাসা বিলীন হয়ে যায় আর বিরহে ভালোবাসার আকর্ষণ সারা জীবন থেকে যায়। সেই সুত্রেই হয়তো পূর্বের ভালোবাসা অক্ষত রয়েছে। তবে অক্ষত ভালোবাসার কাছে আমার আর কোন চাওয়া পাওয়ার নেই।
কথাগুলো কী সাবলীল ভাবে বলে যাচ্ছেন লোকটি। আমিও মন্ত্র মুগ্ধর মতো মোহিত হয়ে শুনে যাচ্ছি। কিছুক্ষন পরেই লোকটি একটি মহিলাকে ডাকলেন। মহিলাটি আসতেই আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর স্ত্রী হিসেবে। আমার পরিচয় দিলেন তাঁর একতরফা প্রেমের প্রথম ও শেষ প্রেমিকা উপাধি দিয়ে। আমি অনেকটাই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ছিলাম। মহিলাটি বললেন,
নিয়াজের মুখে আপনার কথা অনেক শুনেছি।
-আসলে উনি যেভাবে বললেন উনার সাথে আমার তেমন কোনো সম্পর্ক কখনই ছিল না। আপনি দয়া করে কিছু মনে করবেন না।
-আপনি হয়তো ওর আচরণে অস্বস্তি বোধ করছেন। নিয়াজ অনেক উদার মনের মানুষ। ওর ভিতর বাহিরের রূপ একই। এভাবেই বলে দেয় সব কিছু। জীবনে প্রথম ও আপনার প্রেমে পড়েছিল। আমাকে সবই বলেছে আপনার সম্পর্কে। আমি জানি ও মানসিক দিক থেকে কতোটা নির্মল, তাই ওকে নিয়ে আমার কোন দ্বিধা দ্বন্দ্ব নেই। আমি এটাও জানি বর্তমানে ওর সকল সুখ স্বপ্নের বীজ আমার মাঝেই বোনা। আপনি ওর কথায় কিছু মনে করবেন না প্লিজ।
-ঠিক আছে আপনিও এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না। উদারতায় আপনারা দুজনই একই রকম, দুজনের বোঝা পড়তাতেও রয়েছে দৃঢ়তা যা একে অপরকে বিশ্বাস ও আস্থার স্থান দিয়েছে।
ওদিক থেকে কেউ একজন নিয়াজের নাম ধরে ডাকতেই নিয়াজ চলে গেলেন। নামটা খুব পরিচিত মনে হতে লাগলো। অথচ মনে করতে পারছি না। আমার স্বামী মারুফ আমার পাশে এসে জানতে চাইলো তার বস ও তাঁর স্ত্রী কী আলাপ করছিল এতক্ষণ আমার সাথে। নিয়াজের মতো সাবলীল ভাবে আমি সত্য বলতে পারলাম না। বললাম তেমন কিছুই না একে অপরের সাথে পরিচিত হচ্ছিলাম। মারুফ বলল তোমাদের পরিচয়টা আমারই করে দেয়া উচিত ছিল। নেয়াজ স্যার বলছিলেন উনি নাকি তোমাকে চেনেন অনেক আগে থেকেই। আমি আঁতকে উঠলাম প্রশ্ন করলাম কীভাবে? মারুফ বলল উনি নাকি তোমার মেজভাইয়ের বন্ধু ছিলেন। মারুফ কথাটা বলতেই আমার সব কিছু মনে পড়ে গেলো। ভাইয়ার সাথে কতো এসেছে আমাদের বাসায়। খুবই রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হওয়ায় কখনই উনার সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা হয়নি। দুই একদিন কথা হয়েছে তবুও তা খুউব স্বল্প ভাষায়। ভাইয়ার অনুপুস্থিতিতে উনি বাসায় আসলে বলতাম, ভাইয়া বাসায় নেই। অথবা ভাইয়ার অনুপুস্থিতিতে কোন কিছু আমার হাতে দিয়ে নিয়াজ ভাই বলতেন “এটা তোমার ভাইয়াকে দিও” মনে রাখার মতো করে দেখা সাক্ষাত বা কথা হয়নি কখনও। তবে ভাইয়ার মুখে অনেক গল্পও শুনেছি নিয়াজ ভাইয়ের। আমাকে এতোটা ভালোবাসতেন তা কখনই জানতে পারিনি। বেয়ারিং চিঠি যে উনিই লিখতেন তাও কখনই বুঝিনি।
চোখের পাতায় ভেসে উঠলো সেই ক্লাস এইটে পড়া সময়ের কথা। স্কুল থেকে বাসায় ফিরতেই বাবা একটা বেয়ারিং চিঠি দিয়ে বললেন আজকের ডাকে এসেছে। আমি চিঠি খুলে পড়তে শুরু করলাম। পুরো চিঠি ছিল আবেগে পরিপূর্ণ। প্রথম প্রেমের চিঠি পড়তেই কেমন যেন একটা অনুভূতি কাজ করছিল। চিঠির এপিঠ ওপিঠ ভালো করে দেখলাম, না কোথাও কারও নাম লেখা নেই। যত্ন করে চিঠিটা রেখে দিলাম। রাতে খাবারের টেবিলে বাবা কৌশলে অনেক নীতি নৈতিকতার কথা শোনালেন। যার আসল উদ্দেশ্য ছিল আমার নামে আসা বেয়ারিং চিঠি হাসিল করা। বাবা-মায়ের স্নেহ মায়া মমতার গুরুত্ব ও অবদানের আলোচনা তীব্র আবেগপূর্ণ করে তুললেন। আমি খুব সহজেই আবেগে স্নাত হলাম। বাবার ছুঁড়ে দেয়া তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হল না। আমার মনে প্রখর পিতৃবোধ জেগে উঠলো। প্রেমপত্র আসাকে অনুচিত মনে হল। চিঠি পাঠ এবং লুকিয়ে রাখাকে অপরাধ মনে হল। অনুতপ্ত হলাম বিবেকের দংশন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দৃঢ় হলাম। যত্ন করে লুকিয়ে রাখা জীবনের প্রথম প্রেমের চিঠি বাবার হাতে তুলে দিলাম। বাবা চিঠি পেয়ে অনেক খুশি হলেন। আমাকে বললেন আমি সততা প্রকাশে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছি। আমাকে নিয়ে বাবার গর্ব হচ্ছে। আমার মাঝে ততক্ষনে অন্য রকম অনুভূতি কাজ করছে। চিঠিটা বাবাকে দিলাম ঠিকই কিন্তু চিঠি লেখকের প্রতি কেমন যেন একটা হৃদয়ের টান অনুভব করছি।
এরপর প্রায়ই চার পাঁচ মাস আর কোন চিঠি আসেনি। ততদিনে চিঠির লেখককে অনেকটাই ভুলে গিয়েছিলাম। চার মাস পর একদিন পড়ার সময় বইয়ের মধ্যে পেলাম আরেকটি চিঠি। সেই একই হাতের লেখা আবগ মিস্রিত চিঠি। কিন্তু এবারও নাম নেই। কে লিখেছে, বইয়ের মধ্যেই বা আসলো কি করে? কিছুই বুঝতে পারলাম না। এর পরেও আরও কয়েকটি চিঠি বইয়ের মাঝে পেয়েছিলাম। তারপর হঠাৎ করেই চিঠি আসা বন্ধ হয়ে গেলো। আমি প্রতিদিনই বই উল্টেপাল্টে চিঠি খুঁজতাম, চিঠির জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করতাম। কিন্তু সেই যে চিঠি আসা বন্ধ হলো আর এলো না। ততদিনে আমি অচেনা অজানা বেয়ারিং চিঠির লেখকের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তাকে প্রচণ্ড দেখতে ইচ্ছে করতো। তার সাথে অনেক অনেক গল্পও করতে ইচ্ছে করতো। তার লেখা প্রত্যেকটা চিঠির উত্তর লিখতাম। ঠিকানা না জানার কারণে সেগুলো আমার কাছেই জমিয়ে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম কোনো একদিন তাঁর সাথে দেখা হলে সব চিঠি তাকে একসাথে দিব। আমার সে আশাও পুরণ হয়নি। কারন চিঠি আসা বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি তাঁকেও হারিয়ে ফেলেছিলাম।
কোনোরকম কারণ ছাড়াই বাবা একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন
-তোমার কাছে কি এখনও বেয়ারিং চিঠি আসে?
-না
-সত্যি বলছ?
-জি
-কে বেয়ারিং চিঠি লিখেছিল জানতে পেরেছিলে?
-না
-ঠিক আছে যাও।
বেশ তো ভালোই ছিলাম উনাকে চিনতাম না জানতাম না। সেই কবে উনাকে ভুলে গিয়েছিলাম কিন্তু আজ কেন আবার নিয়াজকে দেখে আগের কথা মনে পড়ছে? কেন আমার জানতে ইচ্ছে করছে কেন সে হঠাৎ করেই চিঠি লেখা বন্ধ করে দিয়েছিল? কেনই বা তার পরিচয় গোপন করেছিল? এখনও আমাকে কেনই বা মনে রেখেছে? এখনও কেন আমাকে ভালোবাসে? তাঁর হারিয়ে যাওয়ার পিছনে বাবার কি কোনো ভূমিকা ছিল? এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর বড্ড জানতে ইচ্ছে করছে!
অনেকটা ‘লাঞ্চবক্স’ সিনেমাটার মতো দারুণ একটা প্লট হতে হতেও গল্পটা মার খেয়ে গেল। ঘটনাক্রম, বিন্যাস, চরিত্র, শুরু এবং শেষ – সবগুলোই মনে হয়েছে, আরও অনেকটা যত্ন নিয়ে গড়ে তোলা যেত। চরিত্রগুলোকে অনেকটা জোড়াতালি দিয়েই যেন জুড়ে দেওয়া হয়েছে একে অন্যের সাথে। এ কারণে পড়তে হিয়ে হোঁচট খেতে হয়েছে। গল্পের সমাপ্তি একেবারেই আচমকা এবং সবচেয়ে সাদামাটা। এটা কি গল্পটা দ্রুত শেষ করার তাড়া থেকে?