আমি রাজনীতি খুব ভাল বুঝি না, তবে আমার মনে হয় সবাইকে তো আর রাজনীতিবিদ হবার প্রয়োজন নেই, তবে প্রত্যেকটা মানুষকে রাজনীতি সচেতন হতে হয়। যেহেতু ডটার অফ দ্য ইস্ট শুধু একজন রাজনীতিক নয়, একজন মানুষের জীবনের গল্প তাই একজন রাজনীতি সচেতন মানুষ হিসেবে কৌতুহল নিয়েই পড়া শুরু করেছিলাম। ডটার অফ দ্য ইস্ট বইটা হাতে পাবার পর দুটি সমান্তরাল ধারায় চিন্তা বইছিল। এক,মুক্তিযুদ্ধের স্পর্শকাতর ঘটনাগুলির পর পাকিস্তান দেশটির প্রতি প্রচ্ছন্ন অপছন্দ ভাব যে আমার নেই, তা আমি স্পষ্ট করে বলতে পারি না৷ আর মিডিয়াতে আসা নানা খবর সেই অপছন্দকে উসকে দেয়। সেই দেশের এক মেয়ে, যার বাবা আবার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় তীব্র বিরোধিতা কেবল নয়, ষড়যন্ত্রের অংশই ছিল, তার কথা পড়তে যাচ্ছি, কেমন হবে সেই যাত্রা?
২য়,মুসলিম বিশ্বের প্রথম নির্বাচিত নারী প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টো,মাত্র ৩৫বছর বয়সে নির্বাচিত একজন রাজনীতিক, তার সম্পর্কে জানতে পারব বলে মনে কৌতুহলেরও উদ্রেক হচ্ছিল। বইয়ের প্রথম অংশে মনে হতে পারে, যেন জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাফাই গাওয়ার জন্যই এ বই, কিন্তু দেশকালের উর্ধ্বে যদি উঠতে পারি তবে বলতে হবে একজন বাবার জন্য একজন সন্তানের ভালোবাসার ডালি সাজানো এ বইয়ে। দেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এক দেশপ্রেমিকের খোঁজ পাওয়া যায় এ বইয়ে। বই পড়ার পর পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি আমার মনোভাব বদলালো কি না? নাহ্, বরং বারবার মনে হয়েছে এ এক নিকৃষ্ট জাতির উদাহরণ, এত নিষ্ঠুরতা, এত বরবর্তা! পাক সেনাবাহিনী সম্পর্কে বেনজীর নিজেই বলছেন বারবার কিছুকাল আগে মাত্র তারা (বাংলাদেশ ও পাকিস্তানী সেনাবাহিনী) একই গোষ্ঠী ছিল, তাদের আচরণের ভেতর সামঞ্জস্য থাকা কি খুবই অনভিপ্রেত? তবে স্রষ্টাকে ও রাষ্ট্রকে ধন্যবাদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সেই খুনীর খোলসে না ঢুকে বরং মৈত্রীত্বকে মূলনীতি করতে পেরেছে। (পাহাড়ী ইস্যুর জন্য আমি দুঃখিত, এটাই হয়ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একমাত্র কালোদাগ) পাকিস্তানের জন্ম থেকে সেই দেশের সেনাবাহিনীর ক্ষমতার লালসার স্বীকার হয়েছে বারবার সেই দেশের মানুষ। একটি পশ্চাৎপদ, অনগ্রসর, উদ্রবাদী গোষ্ঠী হয়ে উঠে তাদের এই যে অধঃপতন .. এ দায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্র, এমনকি বিশ্বনেতারাও অস্বীকার করতে পারেন না। বেনজীর এ বইয়ে শুধু তার ব্যক্তিজীবন ও রাজনৈতিক অার্দশের কথাই বলেননি, খোলস উন্মোচন করেছেন সন্ত্রাসবাদের প্রসূতিঘরের। যেহেতু এ বই পড়ে আমরা কেবল বেনজীরের দৃষ্টিকোণ দিয়ে সব দেখি তাই কোথাও হয়ত মনে হবে যে, সেটা অতিরঞ্জিত বা ভ্রান্তিমূলক, (মুক্তিযুদ্ধ বা মুজিব সম্পর্কে বেনজীরের ধারণা অসম্পূর্ণ মনে হয়েছে একটু) কোথাও হয়ত মনে হবে বেনজীর কুসংস্কারের ছায়াপথ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ সরিয়ে আনতে পারেন নি, বা তিনি আর একটু অগ্রসর হতে পারতেন চিন্তা ও মননে। বেনজীর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে সন্তানের জন্ম দেন, তার এ সাহসের জন্য তিনি ভূয়সী প্রশংসার যোগ্য কিন্তু তিনি যখন বলে ওঠেন সন্তান দান নিছক এক প্রাকৃতিক ঘটনা যা নারীর রোজকার কর্মকে ব্যহত করে না, তখন মনে হয় তিনি নিজের শক্তি ও সামর্থ্যের জোরে অন্য নারীদের গর্ভকালীন শারীরিক ও মানসিক কষ্টকে হেয় করছেন(আমার ভুল হতে পারে, আমার এমনটাই লেগেছে)
বেনজীর ভুট্টো একজন আপাতমস্তক রাজনীতিবিদ, তিনি লেখক নন। তাই লেখনি কেমন বা বইয়ের বর্ণনায় তিনি কতটা মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন সে আলোচনা অবান্তর, তবে শেষ পর্যন্ত এটুকু বলাই যায়, তার সাথে আপনি সর্ববিষয়ে একমত হন বা না হন, তিনি যে এক লড়াকু যোদ্ধা, বাবা ও প্রিয় দুই ভাইকে হারানোর পরও নিজের জীবন বাজি রেখে দেশপ্রেমে নিমগ্ন এক আত্মপ্রত্যয়ী মানুষ ছিলেন তিনি, তা আমরা কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারি না৷ বেনজীর ভুট্টোর নৃশংস হত্যা তাই বিশ্ব মানবতার এক বড় বিপর্যয়।
বই শেষে একটা ক্ষোভ কিন্তু থেকেই যায়, পাকিস্তানের ইতিহাসে এমন মানবিক রাষ্ট্রপ্রধান তেমনটা আর আসে নি। বেনজীর কি পারতেন না আনুষ্ঠানিকভাবে একটা ক্ষমা প্রার্থনা করতে বাংলাদেশীদের কাছে? যে ক্ষোভ ও দুঃখ আমরা পুষে চলেছি স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও, আমাদের সেই ক্ষতে একটু তো মলম লাগত পাকিস্তানীদের ক্ষমাপ্রার্থনায়৷ বেনজীরের শাসনকাল খুব অল্পসময় ছিল, তখন তিনি আন্তঃরাষ্ট্রীয় নানা বিপর্যয় সামাল দিতেই ব্যস্ত। বেনজীরের অকাল মৃত্যু আমাদের সেই জানার রাস্তাটা বন্ধ করে দিয়েছে যে বেনজীর দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকলে বাংলাদেশের সাথে কেমন আচরণ করতেন? ক্ষমাপ্রার্থনা করতেন কি না? বা বুঝতে পারতেন কিনা তিনি যতই সন্তান হিসেবে পিতাকে উচ্চাসনে বসান না কেন, বাংলাদেশের সাথে ভুট্টোর আচরণ ছিল ন্যাক্কারজনক। বেনজীর ক্ষমতায় থাকলে বর্তমানে পাকিস্তান একটি ভঙ্গুর ব্যর্থ রাষ্ট্র না হয়ে উন্নতির সোপানে উঠত কি না? আমরা জানি না এসব উত্তর, আমাদের আর জানাও হবে না৷
প্রথম প্রকাশঃ ১৯৮৮। বাংলায় প্রথম প্রকাশ ২০০৮ ,চারদিক প্রকাশনী, মুদ্রিত মূল্যঃ ৪৪০ টাকা।