[জগন্নাথকে ভালোবেসেছিল চৌদ্দ বছরের মাধবী। কিন্তু মাধবীর মা এক গ্রাম্য ডাক্তারের হাত ধরে চলে যায়। বাড়িতে অসুস্থ বাবা শ্রীদাম আর মাধবী থাকে। একদিন শ্রীদামও মারা যায়। একেবারে একা হয়ে যায় মাধবী। সে জগন্নাথের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে কিন্তু জগন্নাথ তার সাথে আর যোগাযোগ করে না। মাধবীর কাছে নিজের জীবন বহন করা কঠিন বলে মনে হয়। সে ফাঁসিতে মরার পরিকল্পনা করে। সে ঘরের চালার সাথে ফাঁসির দড়িও বেঁধে ফেলে। কিন্তু তার পরিকল্পনা সফল হয় না।]
ফাঁসির দড়ি নিয়ে শুয়ে আছে মাধবী। তার বাবা নাই। মা নাই। এ জীবন রেখে কী হবে। এ জীবন বেড়ে উঠবে আর কিভাবেই বা। মানুষের কাছে চেয়ে চিন্তে খেয়ে কি আর জীবনের এতগুলো দিন যাবে? ভাবতে ভাবতে তার চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। ঝাপসা চোখে দেখে, তার বাবার কাটা পা হেঁটে হেঁটে আসছে। হাঁটু থেকে কাটা একটা মাত্র পা হেঁটে হেঁটে আসে কিভাবে। সে ভয় পায়। তার বাবার শরীর দাহ করা হয়ে গেছে। তার বাবার শরীর জগতের মাটি কাদা ধুলো জলে বিলীন হয়ে গেছে। এ কাটা পা পুড়ানো হয়নি। এ কাটা পায়ের কী হয়েছিল কে জানে। মনে মনে ফাঁসে ঝুলে ঝুলে সে দেখছে, মানুষের শোকাক্রান্ত মুখ, শুনছে, মমতাক্রান্ত কথা। মনে মনে মরে এসব দেখতে দেখতে তার চোখ কাঁপে, ঠোঁট কাঁপে, নাক কাঁপছে আবেগে, অভিমানে।
এবার সে কাটা পায়ের বদলে একটা মুরগিকে হেঁটে আসতে দেখে। মুরগিটা আবার কাটা পা হয়। এ এক আজব। কাটা পা মুরগি হয় কোন নিয়মে, মুরগি কাটা পা হয় কোন নিয়মে। সে চোখ কচলায়। পা আর মুরগির ভেলকি থেকে বের হতে চায়।
বাইরে লোকজনের চলাচল এখনো আছে। রাত নিশুতি হয়ে গেলে সে আত্মহত্যা করবে। সে দড়িতে হাত বুলায়। সে মনে মনে ঠিক করে নেয় চালার কোন বাঁশটাতে দড়ি বাঁধবে। ফাঁসির দড়ি বাঁধার বাঁশ ঠিক হয়। মরণ পরবর্তী অবস্থার চিত্র সে মনে মনে ভাবে। তার মরদেহ ঝুলে ঝুলে তাকিয়ে থাকবে দরজার দিকে। গাঁয়ের লোকেরা যখন জানতে পারবে তখন তারা খুব আফশোষ করবে। বলবে, বড্ড ভালো ছিল গো মেয়েটা। পৃথিবী নিজেকে খুব অপরাধী মনে করবে। তার কাছের মানুষগুলোর জীবন থমথমে হয়ে যাবে, বিষাদে ভরে যাবে। তাদের থমথমে হয়ে যাওয়া জীবন, বিষাদে ভরে যাওয়া জীবন আর কোনোদিনও ঠিক হবে না। পাশের বাড়ির যে কাকি ভাত দিয়ে যায় কখনো কখনো সে কিভাবে আঁতকে উঠবে তাও সে মনে মনে দেখে।
তার মনে পড়ে তার মায়ের মুখ। সে যখন শুনবে তার মাধবী আত্মহত্যা করেছে তখন কী সে তার কাজের জন্য অনুতপ্ত হবে না? নিশ্চয় হবে। না-ও হতে পারে। সে তো বেশ সুখেই আছে রমজান ডাক্তারের বাড়িতে। এভাবে কতজনের মুখ তার মনে পড়ে।
এবার তার মনে পড়ে জগন্নাথের মুখ। জগন্নাথের সাথে সে স্কুলে পড়ত। জগন্নাথ তাকে ভালোবাসে বলেছিল। তারপর তো মাধবীর পড়াশোনায় বন্ধ হয়ে গেল। তারপরও জগন্নাথ তাকে ভালোবাসত। তাকে স্বপ্ন দেখাত, স্বপ্ন শেখাত, স্বপ্ন লেখাত চিঠিতে। কিন্তু যেদিন গ্রামে রটে গেল, মাধবীর মা রমজান ডাক্তারকে বিয়ে করে মুসলমান হয়ে গেছে তারপর থেকে জগন্নাথের আর দেখা নেই। দুএকবার খবর নেবার চেষ্টা করেছে মাধবী, জগন্নাথ দেখা করেনি। মাধবী বুঝে নিয়েছে জগন্নাথ তাকে আর ভালোবাসে না। তারই আবার দোষ কী, যার মা মুসলমান হয়ে গিয়ে মুসলমানের ঘরে উঠেছে, জাত খুইয়েছে তখন তার সাথে সম্পর্ক রাখার আর দরকার কী। যার মা এমন হতে পারে তার মেয়ে কী ভালো হতে পারে? এসব কথা মনে পড়াতে একটা কান্নার ঢেউ উথলে আসে বুক ঠেলে একেবারে। জগন্নাথের উপর তার অভিমান হয়। মানুষের সকল কারবার অদ্ভুত। মানুষ বড় স্বার্থমাখা। স্বার্থপাখা আছে মানুষের, ঐ পাখাতে উড়ে উড়ে বেড়ায়। মানুষের সকলকিছুর চারপাশে কুয়াশার বেড়া। তার বাবার কথা মনে পড়ে, তার বাবা শ্রীদাম রেখার জ্যামিতি বোঝাতে গিয়ে বলেছিল, সরলরেখা শুধু সরলরেখা আঁকাতে কাজে লাগে, এছাড়া সরলরেখা কোনো কাজে লাগে না। বক্ররেখা ছাড়া ছবি আঁকা অসম্ভব। ভূ-জ্যামিতি তাই তো বলে, সরলরেখা বলে কোনোকিছু নাই। মানুষের ক্ষেত্রেও তাই গো মা।’
বাবার কথা তখন ভালো করে ধরতে পারেনি মাধবী। এখন বুঝতে পারে বাবার কথায় ঠিক, একটা মানুষ কখনোয় সরলপথের পথিক হতে পারে না। সরলপথের পথিক হওয়া আসলে সম্ভব নয়। একটা মানুষ তার নিজের জন্য ভাবে একভাবে কিন্তু তার পাশের মানুষ তাকে নিয়ে ভাবে অন্যভাবে, তার গ্রামের মানুষ ভাবে আরেকভাবে, তার রাষ্ট্রের মানুষ ভাবে আরেকভাবে, চারপাশে সামাজিক আর প্রাকৃতিক পরিবেশ ভাবে আরেকভাবে। ফলে একটা মানুষ যখন নিজের ভাবনা করা পথে চলতে চায় তখন তার পাশের মানুষের ভাবনার সাথে, আরো সব মানুষের ভাবনার সাথে বেশ সংঘর্ষ বেঁধে যায়, সংঘর্ষ বেঁধে যায় আবহাওয়া আর পরিবেশের সাথে ফলে কোনো ভাবনাই সঠিক পথ পায় না। সে নিজেকে নিয়ে যা ভেবেছিল তা হয় না, অন্যরা তাকে নিয়ে যা ভেবেছিল তাও হয় না। এমন কিছু হয় যা কেউই ভাবেনি। আবার একটা মানুষও আসলে দুটা মানুষ। তাদের ভেতর যুদ্ধ চলতেই আছে। দুটা মানুষ কারণ তার দেহ আছে আর মন আছে। দেহের কারবার আর মনের কারবার এক নয়। দেহ বাঁচতে চায় যে পথে সে পথে তার মন বাঁচে না। মন যে পথে বাঁচতে চায় সে পথে দেহ বাঁচে না। দুটোর পথের মিল হওয়া সবচে কঠিন। দেহ বলে, ভিক্ষা করে হলেও, অপমানিত হয়ে হলেও খাবার সংগ্রহ করে নাও, মন বলে, মরে যাও কিন্তু ভিক্ষা কোরো না, অপমানিত হয়ো না। মানুষ এক কিম্ভূত অবস্থার ভেতরে পড়ে আছে। এসব ভাবতে ভাবতে তার ভেতর ভাবনার কোলাহল ওঠে। সে বুঝতেই পারে না, বাইরের কোলাহল ডুবে গেছে ঘুমে, পথে কেউ নাই, পথ দিয়ে শুধু চলে যাচ্ছে পথ, চলে এসেছে ফাঁসিতে ঝুলে পড়ার সময়।
‘ফাঁসির সময় বয়ে যাচ্ছে’, কে যেন বলে তার কানের কাছে ফিসফিস করে। সে ধড়ফড় করে ভাবনার কোলাহল থেকে বেরিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তার কান্না আসে। অভিমানে বুক ভরে ওঠে। জগন্নাথ কি পারত না তাকে এসে কিছু সান্ত্বনা বাক্য দিতে? সে তার দড়ি বাঁধে বাঁশের সাথে। তার বাবা কি এসে বলতে পারে না, ‘এই যে রে মা, আমি মরিনি, তোকে ভয় দেখাচ্ছিলাম মাত্র? আয় আমার সোনা।’ সে টেনে দেখে, শক্ত হলো কিনা। টানে চালার বাঁশ মচ মচ শব্দ করে ওঠে। তার মা কি এসে বলতে পারে না, মাধবী ফাঁসির দড়ি খুলে ফেল মা, আমি আছি, ‘আমি যে নেই বলে মনে করেছিলি’ সেটা তোর স্বপ্ন ছিল মাত্র।’ বাঁশের সাথে দড়ি বাঁধা হলে এবার ফাঁস তৈরি করে। ফাঁস তৈরি হয়ে গেছে। ঘরের ভেতর থাকা যত টিকটিকি, তেলাপোকা, ইঁদুর, ছারপোকা মাথা বের করে পিটপিট করে মাধবীর দিকে তাকিয়ে আছে। সে ফাঁসে মাথা ঢুকাতে যাবে এমন সময় হুড়মুড় করে কয়েকজন তার ঘরে এসে প্রবেশ করে।
[ঐ কয়েকজন মাধবীকে অপহরণ করে নিয়ে যায় আর খুব দূরের এক জেলার পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়।]
খুব ভালো লেখা প্রিয় কবি সাহিত্যিক গল্পকার ও উপন্যাসিক, এই ভাবেই সমাজের কথা ও মন অনুভূতি প্রকাশ করে চলুন।