চমকে গেলেন? ভাবছেন সুন্দরবনের বাঘ বুঝি শহরে ঢুকেছে! এখনই ছুটে পালাবেন? না, আপাতত পালাতে হবে না। ব্যাপারটি মোটেই এতো ভিতিকর নয়। কেন না আমি যে বাঘের গল্প শুনাতে যাচ্ছি সে ছবির বাঘ। গর্জন করে কিন্তু ঘাড় মটকায় না।
যারা চারুকলা বা পাবলিক লাইব্রেরির সামনে দিয়ে কখনও হেটে গেছেন তাদের নিশ্চই একবার হলেও চোখে পড়েছে দেয়ালে বা লোহার গ্রিলে আটকানো হরেক রঙয়ের বাঘের ছবি। ছবিগুলোর সামনে দাঁড়ানো মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক। উস্কো-খোস্কো চুল দাড়িতে সদা হাস্যোজ্জল এক দ্বীপ্তিমান চিত্রশিল্পী। নাম তার নাজির হোসেন। বাঘের ছবি আঁকেন, বাংলাদেশের বাঘ। বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহ্য পটচিত্রের ঢঙে আঁকেন বলে নিজের নামের আগে পটুয়া শব্দটি ব্যবহার করতে পছন্দ করেন তিনি।
বাঘের নামটি শুনলেই আমরা ভয় পাই। মনে হয় এই বুঝি হালুম বলে তেড়ে আসবে! মটকে দেবে ঘাড়! কিন্তু নাজির হোসেনের বাঘ ঠিক তার উল্টো। এই বাঘ একতারা-দোতারা বাজায়। সে কখনও নৌকা চালায় আবার কখনও বা আকাশে ওড়ে। এই বাঘের মাথাটা বড় কিন্তু দেহ ততটা নয়। বাঘ আবার হালচাষও করে। তার লেজ জুড়ে থাকে সদা সতর্ক, চঞ্চল নিরীহ পাখি। এই বাঘ স্বভাবে শান্ত আর শান্তির বার্তা প্রচার করে বেড়ায়।
নাজির হোসেনের ছবি আঁকা শুরু হয়েছিল সেই ছেলেবেলা থেকে। আট ভাইবোনের মধ্যে কারোরই ছবি আঁকার অভ্যাস ছিলো না। পূর্বপুরুষের ছিলো কি না তাও তার জানা নেই। মায়ের তৈরী নকশি কাথা, হাত পাখায় করা বিভিন্ন নকশা, মাটির ঘরের দেয়ালের লেপন, কুমার বাড়িতে তৈরী নানা রকম মাটির জিনিসে অদ্ভুত সুন্দর নকশায় কৈশোরেই মন্ত্রমুগ্ধ নাজির ধীরে ধীরে নকশার প্রেমে পড়ে যান। এই প্রেমে বিচ্ছেদ আসেনি মধ্যবয়সে এসেও। তাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে ভাই বোনদের সবাই চাকরি বা ব্যবসা করেন। সবাই চাইতেন নাজির হয়তো তাই করবে। কিন্তু ¯স্রষ্টার ইচ্ছা ছিলো অন্যকিছু। তাই চিত্রশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন তিনি। আঁকা শুরু করলেন পটচিত্র । এমন নেশায় পেয়ে বসলো যে লেখাপড়াটাও আর বেশীদূর এগোয়নি। ছবি আঁকাতেও কিন্তু তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ সম্ভব হয়নি। আঁকতে আঁকতে তার ছবির প্রথম প্রদর্শনি হলো ১৯৯৪ সালে পার্বতীপুরে ১২ বছর বয়সে। প্রসংশার জোয়ারে ভাসলেন শিশু পটুয়া। উৎসাহ বেড়ে গেলো আরো। সেই উৎসাহেই ১৯৯৬ সালে এক বন্ধুর সাথে ঢাকায় বেড়াতে এলেন। রাজধানীর রং কিছুটা গায়ে মেখে ফিরে গেলেন গ্রামে। তারপর ২০০০ সালে স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্যেশ্যে চলে এলেন মায়ের কোল ছেড়ে। এখন পটচিত্র তৈরীই তার পেশা। এক সন্তান আর শিক্ষিকা স্ত্রী নিয়ে তার বাবুই পাখির সংসার বেশ আনন্দেই কেটে যাচ্ছে। বাসায় ছোট একটি ছবি স্টুডিও করেছেন তিনি। এখনও পর্যন্ত তার ছবির ৫০টি প্রদর্শনী হয়েছে। জাপান সরকারের আমন্ত্রনে সেখানে তার পটচিত্রের প্রদর্শনী হয়েছে ২০১৩ সালে। তার আঁকা একটি বাঘের ছবি ২০১৫ সালে বাংলাদেশে জাপান দূতাবাস মাসকট হিসেবে ব্যবহার করেছে। সেই মাসকট আজো যত্নে রক্ষিত আছে জাপানে। মার্কিন এক চলচ্চিত্র পরিচালক তার আঁকা পটচিত্র নিয়ে শিশুদের জন্য একটি বই লিখছেন। তার আঁকা বাঘের ছবি ব্যবহৃত হচ্ছে টি-শার্টে, প্লে-কার্ডে। পটুয়া নাজির হোসেন এখনও স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নে বিভোর হন। স্বপ্ন দেখেন ছেলেটাকে উপযুক্ত মানুষ করার। জন্মস্থান পার্বতীপুরে একটা লোকশিল্প যাদুঘর করার স্বপ্ন দেখেন তিনি। আর সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠানের সহযোগীতা পেলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পটচিত্রটি তিনিই আঁকতে চান। যেখানে বাংলাদেশের মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে গর্জন ছাড়বে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
টাইগার নাজির