আমরা পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে কর্মরত থাকাবস্থায় ২০১১ সালের আগস্টে সাত সদস্যের একটি টিম চীন ভ্রমণ করেছিলাম। বিশ্বব্যাংকের আয়োজনে প্রকল্পের পুনর্বাসন সংক্রান্ত কাজে অন্যান্য প্রকল্পের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য এটা ছিল একটা স্টাডি ট্যুর। সাত দিনে নানজিং, আনহুই ও বেইজিং-এ তিনটি প্রদেশে বিশ্বব্যাংকের সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প সাইট, হোহাই ইউনিভার্সিটি, National Research Center on Resettlement (NRCR) ও চীনের বিভিন্ন হেরিটেজ সাইট ও দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করি। এরপর ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে মেট্রোরেল প্রকল্পে কর্মরত থাকাবস্থায় মেট্রোরেলের ব্যবস্থাপনা, নির্মাণ ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয় দেখার জন্য আট সদস্যের একটি টিম জাপান ভ্রমণ করি। টোকিও, ওসাকা, কিওটো, নাগোয়া ও হিরোশিমাতে সাত দিন ব্যাপী ছিল আমাদের স্টাডি ট্যুর। মেট্রোরেলের নির্মান, মেরামত, ডিপো ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়সহ জাপানী দ্রুত গতির ট্রেন সিনকানসেনে ভ্রমণ, হিরোশিমার স্মৃতিসৌধ ও স্মৃতি যাদুঘরসহ বিভিন্ন হেরিটেজ সাইট দেখার সুযোগ হয়েছিল আমাদের। সেই ভ্রমণের আলোকে বাস্তব অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ ভ্রমণকাহিনি “ চীন জাপানে যা দেখলাম”।
১_ চীনে স্টাডি ট্যুরের প্রস্তুতি
আমরা পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে কাজ করছি। উপ-পরিচালক (পুনর্বাসন) হিসেবে কর্মরত রয়েছি প্রকল্পের শুরু থেকে। এ প্রকল্পে এক হাজার একর এর উপর বেশি জমি অধিগ্রহণ করা হবে। পনেরো হাজারের বেশি পরিবারের আশি হাজার মানুষ এর মাধ্যমে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদের জমি, বাড়ি-ঘর, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান, কৃষি খামার, ক্ষুদ্র ব্যবসায় ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। স্থানান্তরিত হবে প্রায় ছয় হাজারের বেশি পরিবার। স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল অধ্যাদেশ, ১৯৮২ অনুসারে তাঁরা ক্ষতিপূরণ পাবে। কিন্তু সেই ক্ষতিপূরণ দিয়ে তাঁরা পূর্বের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে না। তাদের জীবিকাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সে সময়ের ভূমি অধিগ্রহণ আইন অনুসারে তাঁরা জমির যে ক্ষতিপূরণ পাবে তা দিয়ে অধিগ্রহণকৃত জমির এক তৃতীয়াংশের বেশি জমি ক্রয় করতে পারবে না। এ ছাড়া অন্য অনেক ধরণের ক্ষতির বিষয়ে বিদ্যমান আইনে কোনো ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেই। এ কারণেই উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও জাইকা প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব পরিবেশ ও সামাজিক গাইডলাইন। উক্ত সামাজিক গাইডলাইন মেনে সামাজিক কর্ম পরিকল্পনার আওতায় পুনর্বাসন কর্ম পরিপকল্পনাসহ অনেকগুলি ডকুমেন্ট তৈরি করতে হবে এ প্রকল্পের আওতায়। এ জন্য আমরা পুনর্বাসন টিম কাজ করছি। সাথে রয়েছে দেশি বিদেশি পরামর্শকগণও। এ কাজের জন্য নিয়োজিত রয়েছে একটি এনজিও। বিশ্বব্যাংকের তৈরি সামাজিক গাইডলাইনের আলোকে বিশ্বব্যাংকের সহায়তাপুষ্ট সকল প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিগণের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। বিশ্বব্যাংকের হেড অফিস ও লোকাল অফিসের কর্মকর্তাগণ তা বাস্তবায়ন মনিটর করে। পদ্মাসেতুর মতো একটি বিশাল প্রজেক্টের পুনর্বাসন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য বিশ্বব্যাংক তাই তাদের অন্যান্য প্রকল্পে অনুসৃত পুনর্বাসন কর্মপরিকল্পনা ও প্রায়োগিক পদ্ধতি সম্পর্কে বাস্তব ধারণা অর্জনের জন্য চীন ও ভারতের কয়েকটি প্রকল্পে ও সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে/ প্রতিষ্ঠানে এ প্রকল্প হতে একটি টিমের স্টাডি ট্যুরের আয়োজন করে। সেতু বিভাগ, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ও পদ্মা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষ থেকে কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক, মুন্সীগঞ্জ ও প্রকল্পের কনসালট্যান্টসহ সাত জনের একটি টিম এক সপ্তাহের জন্য চীন ভ্রমণের উদ্যোগ নেয়া হয়।
এ ভ্রমণের জন্য বিশ্বব্যাংকের গ্রীন সিগন্যালের পর আমাদেরকে তৈরি করতে হয়েছে স্টাডি ট্যুর রিপোর্ট। প্রকল্প কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের পর তা বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ হয়ে সেতু বিভাগে প্রেরণ করা হয়। এ ট্যুরের জন্য অর্থের বিনিময়ে চীনে একজন ট্রেনিং ফ্যাসিলিটেটর নিয়োগ করা হবে । সে আমাদের প্রোগ্রামের সব আয়োজন করবে। হোটেল ঠিক করা, এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করা, হোটেলে পৌঁছানো, হোহাই ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রশিক্ষণ আয়োজন, সাইট ভিজিটের ব্যবস্থা ও খাবারের ব্যবস্থা সবই তাঁর দায়িত্বে। হোহাই ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টার ফর রিসেটেলমেন্টের ডাইরেক্টর Dr. G0-Shi –কে আমাদের স্টাডি ট্যুরের ট্রেনিং ফ্যাসিলিটেটর নিয়োগ করা হয়। তাঁর সাথে চুক্তিও হয়। সেতু বিভাগের অনুমোদনের পর আমাদের চীন যাত্রার সরকারি আদেশ (জিও) জারি হয়। সেতু বিভাগ থেকে একজন, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ থেকে একজন, জেলা প্রশাসক, মুন্সীগঞ্জ, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প থেকে তিনজন ও প্রকল্পের কনসালট্যান্ট এই সাত জনের টিমের সাত দিনের জন্য চীনে স্টাডি ট্যুর ০১ আগস্ট থেকে ০৭ আগস্ট ২০১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। নানজিং, হেফেই ও বেইজিং-এই তিনটি সিটিতে আমাদের প্রোগ্রাম। নানজিং চীনের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের জিয়াংশু প্রদেশের রাজধানী, হেফেই পূর্বাঞ্চলীয় আনহুই প্রদেশের রাজধানী এবং বেইজিং চীনের রাজধানী যা চীনের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত।
স্টাডি ট্যুর প্রোগ্রামটি পদ্মা সেতু প্রকল্পের তত্ব্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ মনজুরুল ইসলাম, আমি কৃষ্ণ কান্ত বিশ্বাস, উপ-পরিচালক (পুনর্বাসন) ও প্রকল্পের সেফগার্ড স্পেশালিস্ট ড. মোহাম্মদ জামান বিশ্বব্যাংক, চীনের হোহাই ইউনিভার্সিটির এনআরসিআর এর পরিচালক Dr. G0-Shi, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ও সেতু বিভাগের সংগে প্রায় দুই মাস ধরে যোগাযোগ ও পত্র বিনিময় করে তৈরি করা হয়। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এ স্টাডি ট্যুর আমাদের জন্য একটি অত্যন্ত আনন্দের খবর। কারণ, এ ট্যুর শুধুমাত্র বিদেশ ভ্রমণই নয় আমাদের কাজের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা অর্জন ও তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রাখবে।
আমরা টিকিট ও ডলার হাতে পেলাম। সবার পাসপোর্ট রেডি আছে কি না চেক করা হল। চীনে সরকারী পাসপোর্টের ভিসা লাগে না। সবারই সরকারী পাসপোর্ট। একজনের শুধু সরকারি ছিল না। সরকারি আদেশের কপি জমা দিয়ে পাসপোর্ট অফিস থেকে তা সরকারি পাসপোর্ট হিসেবে করা হল। এরপরই আমাদের যাত্রা শুরু হবে। সব কিছু হাতে পেয়ে মনটা বেশ ফুরফুর করছে। চীন ভ্রমণ এই প্রথম। চীনে ভাষার খুব সমস্যা। কারণ অধিকাংশ চীনা নাগরিকই ইংরেজি জানে না। আমরা যেহেতু গ্রুপে যাচ্ছি, তাই সমস্যা কম হবে। আর আমাদের জন্য ইন্টারপ্রেটরেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। তা ছাড়া আমাদের গ্রুপে পূর্বে চীন ভ্রমণ করা কয়েকজন সদস্য রয়েছেন বিধায় আমরা অনেকটাই নিশ্চিন্ত যে অনেক বিষয়েই তাঁদের পরামর্শ নেয়া যাবে।
২_ পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের অভিজ্ঞতা
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে ২০০৯ সালের জুলাইয়ে যোগদান করি। চাকুরি জীবনের পনেরো বছরের বেশী সময় মাঠ প্রশাসনে নিয়োজিত ছিলাম। প্রথমে জেলা প্রশাসনে শিক্ষানবিস সহকারী কমিশনার হিসেবে তৃতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হিসেবে কাজ করি। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, কেস এনোটেশন ইত্যাদি শেষে দ্বিতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেসি লাভ করে কোর্টে বিচার কাজ পরিচালনা করি। এর পর একাধিক জেলায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। পরবর্তীতে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়ে আমলি আদালত ও বিচার কার্য পরিচালনা ও জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন সেকশনের দায়িত্ব পালন করি। তিনটি উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে নিয়োজিত ছিলাম। বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জে উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ২০০৮ সালে আমেরিকা ভ্রমণের পর আমার অন্তদৃষ্টিতে কিছু পরিবর্তন আসে। প্রশাসন ও সরকারী কার্যক্রমে কিছু নতুন চেতনায় আমি উদ্বুদ্ধ হই। মাঠ প্রশাসন থেকে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে যোগদানের পর আমি সে ধরনের একটি কাজের পরিবেশ পাই। যেখানে নিজের কিছু অবদান রাখার সুযোগ আছে।
এ প্রকল্পে আমার কাজ ছিল ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করা। পদ্মা সেতুর তৎকালীন উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক ও জাইকার কনসালট্যান্টদের সংগে কাজ করা, তাদের প্রধান কার্যালয় থেকে আসা মিশন মোকাবিলা করা, প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পুনর্বাসন কর্ম পরিকল্পনা ও সামাজিক কর্ম পরিকল্পনা তৈরি করা, পুনর্বাসন সাইটের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে নিয়োজিত এনজিওর কার্যক্রম মনিটরিং, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ইত্যাদি কার্যক্রমের সাথে যুক্ত ছিলাম। মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও মুন্সীগঞ্জ এই তিনটি জেলায় ভূমি অধিগ্রহণের কার্যক্রম ছিল। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নির্মান করা হয়েছিল পাঁচটি পুনর্বাসন সাইট। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ঢাকা থেকে সাইট ভিজিটে যাওয়া হতো মাওয়া, শ্রীনগর, জাজিরা ও শিবচর উপজেলায় অধিগ্রহনকৃত এলাকায়। তিনটি জেলার জেলা প্রশাসনের সাথেও তাদের অফিসে গিয়ে সভা করা হতো। এ প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও পুনর্বাসন কার্যক্রম খুবই নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়েছিল। যার ফলে এ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক টাকা না দেয়ার আগেই ওঠা দুর্ণীতির অভিযোগ প্রতিহত করতে দেশীয় অর্থায়নে ব্যয়িত ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের সফলতার উদাহরণ জোরালো ভূমিকা রেখেছিল। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ মিথ্যা প্রমানিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে গেলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মানের সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশকে অনেক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। পদ্মা সেতু আমাদের জাতির গর্ব, বিশ্ববাসীর কাছে এক বিস্ময়। পদ্মাসেতু খুব শীঘ্রই চালু হয়ে যাবে চলাচলের জন্য। এ সেতুর নির্মাণ কাজে যুক্ত হতে পেরে নিজেকে ধন্য ও গর্বিত মনে করি।
৩_ তিন বছর পর ঠিক একই দিনে বিদেশ ভ্রমণ আমেরিকা থেকে চীন
০১ আগস্ট ২০১১ খ্রিস্টাব্দ
ঠিক তিন বছর আগে ০১ আগস্ট ২০০৮ তারিখে আমেরিকা যাত্রা করেছিলাম ঢাকা বিমান বন্দর থেকে। পৃথিবীর মহাশক্তিধর দেশ আমেরিকা ভ্রমণের পর তারই প্রতিদ্বন্দ্বী দ্বিতীয় ক্ষমতাধর দেশে যাত্রা। আর্থিক অবস্থান ও ক্ষমতায় এখন আমেরিকার পরপরই চীনের অবস্থান। চীনদেশ নিয়ে ছোটবেলা থেকে আমার মনে কিছু একান্ত নিজস্ব ধারণা গেঁথে ছিল যার কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। চীনদেশ বলতেই মনে হতো কেমন এক রহস্যময় দেশ, সব কিছুই যেন ধোঁয়াসায় ঘেরা, মানুষেরা যেন যক্ষের মতো, সাপ ব্যাঙ খায় এক আজব দেশ। চীন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু প্রকাশিত না হওয়াই যেন ছোট কাল থেকে এ রকম একটি বায়বীয় ধারণা মনের মধ্যে রয়ে গেছে। সে জন্য চীন যাওয়ার আগে এক ধরণের বিশেষ কৌতূহল মনের মধ্যে জেগে রয়েছে। না জানি কি হয় সেখানে!
আমাদের ফ্লাইট রাত দুইটা বিশ মিনিটে। তাই বাসা থেকে রাত এগারোটার দিকে রওয়ানা দিলাম। রাতে ট্রাফিক জ্যাম কম থাকায় চল্লিশ মিনিটের মধ্যে এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম। সাথে স্ত্রী স্নিগ্ধা, মামনি ভাস্বতী, বাপী নক্ষত্র ও তাদের দিদিমা ছিল। এবার বাপী প্রথম এয়ারপোর্টে এলো তার বাপিকে See-off করতে। আমেরিকা ভ্রমণের সময় তাঁকে নিয়ে বেশ কৌতূহল ছিল। কারণ সে ছিল তখন তাঁর মায়ের গর্ভে। আমেরিকা গিয়ে সেখানকার আয়োজকদের সংগে বেশ মজা হয়েছে। কারণ আমাদের টিমের চারজনের তিনজনেরই স্ত্রীই ছিল সন্তান সম্ভবা। এমন কি তাঁর জন্য গিফটও নিয়ে এসেছিলাম। যা তাঁর জন্মের পর তাঁকে দেয়া হয়েছে। সে গিফট এখনও আছে। এখন চীন যাওয়ার সময় সে প্রায় তিন বছর বয়সী। অনেক কিছুই বুঝে। তাই সে এবার আমার সংগে যাওয়ার জন্য বায়না ধরেছে। তাঁকে অনেক বুঝিয়ে শান্ত করলাম। বললাম তোমার জন্য অনেক খেলনা নিয়ে আসবো। মামনির চোখও ছলছল করছে। বাপিকে এভাবে বিদায় জানাতে অনেক কষ্ট হল। চোখের অশ্রু চেপে মা-মনি, বাপী ও স্নিগ্ধার কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
সবাই চলে এলে আমরা ০১ আগস্ট ২০১১ খ্রিস্টাব্দ রাত দুইটা বিশ মিনিটে হযরত শাহজালাল এয়ারপোর্ট থেকে চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইনে করে রওয়ানা দিলাম। কুনমিং হয়ে নানজিং যাবো আমরা। চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইনস। আমার সিট পড়লো জানালার পার্শ্বে। আমি সবসময় এটাই চাই। কারণ, আমি দেখি চারদিক। খুঁজে নেই অজানাকে। প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখে আমি মুগ্ধ হই। রাতে যেহেতু রওয়ানা হলাম, তাই ঢাকার আকাশে শুধু তারা দেখলাম। আর নিচে ঢাকা শহরের রাতের সৌন্দর্য দেখলাম। রাতে যেন আলোর মালায় জড়িয়ে আছে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। জড়িয়ে আছে ভবনগুলো সেই আলোর মালায়। মিট মিট করে জ্বলছে। এই আলোর মালা সত্যিই অন্যরকম সৌন্দর্যের, অন্যরকম অনুভূতি জাগায় মনে। যদি এই আলোর মালার মতো সবার মনে ভালোবাসার মালা জড়িয়ে থাকতো সবার মনে। কি আনন্দ, কি অপূর্ব অনুভূতি হতো তাহলে। পাল্টে যেতাম আমরা, পাল্টে যেতো দেশ।
প্লেন ছাড়ার কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়লাম। কারণ, অনেক সময় ধরেই জেগে আছি। রাতে পরিমানমতো ঘুম না হলে আমার শরীর খারাপ লাগে। ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠলাম জানালায় আলোর পরশ পেয়ে। তাকিয়ে দেখি নিচে পাহাড় শ্রেণি উচু নিচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাহাড়ের উপরে মেঘের সমুদ্র যেন। ভোরের সূর্যের আলো ঝিকমিকিয়ে পড়ছে সেই মেঘের উপর। মেঘ আর আলোরাশি মিলে যেন অভূতপূর্ব রঙের সহস্র সম্মিলনে বিচিত্র ধারা বিচ্ছূরণ। চোখ ধাধানো দৃশ্য। মনে হয় চেয়ে থাকি অবিরাম। এইখানে থেকে যাই যুগ থেকে যুগান্তর। প্লেন চলছে ঘন্টায় ন’শ কিলোমিটার বেগে। তবু এ দৃশ্যের যেন শেষ নেই। মন ভরে দেখে নেই এ দৃশ্যাবলি। মনে এসে যায় কবিতার কিছু লাইন:
তুমি অসম্ভব সুন্দরের প্রতিমূর্তি হয়ে
সেজেছো অপরুপে
মেঘ রৌদ্রের বর্ণচ্ছটায় চোখ ধাধানো ঝলকানিতে
তুমি অনিন্দ্যসুন্দর নিরুপম অধরা নিসর্গ
তুমি জাগাও হৃদয় মননে অসীম শান্তির ধারা
এমন সৌন্দর্য মাধুরীতে নিঃশেষিত হতেও যেন
মনে জাগে অনন্ত সুখের আস্বাদন।
এমনি করে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা কুনমিং-এর দিকে। ভোর হলেও মাঝে মধ্যেই নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল একটা আচমকা ঝাঁকুনিতে। মনে হল প্লেনটা কয়েকশ ফুট নিচে পড়ে গেলো এক সেকেন্ডেরও অনেক কম সময়ের মধ্যে। সবাই চমকে উঠেছে। কেউ আবার চীৎকার শুরু করে দিয়েছে। এর মধ্যেই দেখা গেলো প্লেন আবার উপরে উঠে এসেছে এবং দু একটা ঝাঁকুনি দিয়ে আবার সামনে চলতে শুরু করেছে। কিছুই বুঝতে পারলাম না। মনে হলো একটা জীবন ফিরে পেলাম। প্লেনটা যদি ব্যাক করে না উঠতে পারতো তাহলে এতক্ষণে আমাদের আর খুঁজে পাওয়া যেতো না। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যে নিউজ হয়ে যেতো ঢাকা থেকে কুনমিংগামী চায়না ইস্টার্ন এয়ারলাইনসের একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। যাত্রীদের মধ্যে কারও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই। পরবর্তীতে আমাদের সংগে থাকা বাংলাদেশী কানাডিয়ান কনসালট্যান্ট ড. জামান বলছিলেন যে, প্লেনটা এয়ার পকেটের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। এয়ার পকেট হলো বায়ুশূণ্য অবস্থা। সেখানে কোন বাতাস না থাকায় প্লেনের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়। ফলে প্লেন বড় ধরেনর ধাক্কা খায়। দক্ষ পাইলট না হলে বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যা হোক, আমাদের পাইলট ও পরম করুনাময় ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই এ যাত্রায় প্রাণটা বাঁচিয়ে দেয়ার জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা কুনমিং সিআই এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করবো। জীবনের প্রথম চীনের মাটি স্পর্শ করা। চীনদেশ ভ্রমণের স্বাদ কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে। তাই অজানা আনন্দ উপলব্ধি শুরু করলাম।
কৃষ্ণ কান্ত বিশ্বাস– জন্ম মাদরীপুর জেলার কালকিনি উপজেলার শশিকরে এক মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারে। পিতা হরিবর বিশ্বাস ও মাতা মনতারা বিশ্বাস। শশিকর থেকে এসএসসি ও এইচএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক সম্মানসহ স্নাতকোত্তর এবং বিএড ও এমএড, এসইউবি থেকে এনভায়রনমেন্টাল সাইন্সে মাস্টার্স এবং এনএপিডি থেকে পিজিডি অন প্লানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট কোর্স করেন। মাঠ প্রশাসনে ম্যাজিস্ট্রেসি, সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার ছাড়াও পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে উপ-পরিচালক (পুনর্বাসন) ও সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে যুগ্মসচিব পদে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে মেট্রোরেল প্রকল্পে অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি আমেরিকা, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড, সিংগাপুর, জাপান, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম ভ্রমণ করেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ-ভ্রমণকাহিনী পার্ল হারবার থেকে মানালি ।