জৈষ্ঠ্য মাসের তপ্ত দুপুরেও খেলার বিরাম নেই। আম বাগানে গাছের ছাঁয়ায় চলে খেলা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম খেলা। কখনও দু’জন কখনও আট-দশজন কখনওবা তারও বেশি। ডাংগুলি, বউচি, বদন, আতাপাতা, কানামাছি আরও কতো রকমের খেলা চলে দিনভর। তবে মার্বেল ও লাটিম খেলতেই বেশি ভালোবাসে অঞ্জন।
জৈষ্ঠ্য মাসে আম গাছের নিচে খেলার কিছু সুবিধা রয়েছে। খেলাও হয় আবার আমও কুড়ানো হয়। সেক্ষেত্রে খেলার সময়ের বিস্তৃতি যতো বেশি হবে পাকা আমের কালেকশনও ততো বেশি হবার সম্ভাবনা। তাইতো আজ কয়েকদিন ধরে খেলা চলছে অবিরাম, ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি। কিন্তু আজ খেলায় যেন কিছুতেই মন বসাতে পারছে না অঞ্জন। সদ্য দশ বছরে পা দেওয়া অঞ্জন তার বাবা মার কথা ঠিকমতো না বুঝলেও এতোটুকু বুঝতে পেরেছে যে, তার বাবা মার সঙ্গে তাকেও খুব শীঘ্রই কোথাও যেতে হবে।
অঞ্জনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু আরিফকে তাই কাছে ডেকে কানে-কানে ফিসফিস করে বলে, ‘জানিস, কাল না, আমি বাবা মার সাথে এক জায়গায় যাবো।’
‘কোথায় যাবি? কবে আসবি?’ বলে আরিফ।
‘জানি না রে। ফিরে আসলে তোকে সব জানাবো।’
‘কেন যাবি তোরা?’
‘তাও ঠিক জানি না। তবে মা-বাবা বলাবলি করছিলো শহরে নাকি গন্ডগোল শুরু হয়েছে।’
‘শহরে গন্ডগোল হচ্ছে তাতে কী? এটা তো শহর নয়, আর তাছাড়া আমরা তো কোথাও যাচ্ছি না, তাহলে তোরা কেন যাবি?’
অঞ্জন শুধু তাকিয়ে থাকে কারণ সে বেশি কিছু জানে না। আর জানবেই বা কী করে? তার বাবা মা-ই তো ঠিকমতো জানে না তারা কোথায় যাবে।
দিনটি ১৯৭১ সালের ২১শে মে, সারা রাত ঘুম আসেনি অঞ্জনের ছোট্ট দুটি চোখে। কতো বিচিত্র ভাবনা উঁকি দিয়ে উঠছিলো তার মনে।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশের জন্য হাজার হাজার মুক্তিকামী জনতা ঝাঁপিয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধে। সবার চোখে একটিই প্রত্যয়; যে করেই হোক, যতো রক্ত দিয়েই হোক দেশকে শত্রু মুক্ত করতেই হবে। সেসময় অধিকাংশ মানুষ বিশেষ করে গ্রামের মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে যুদ্ধ না বলে গন্ডগোল বলতো। আর সেসময় সংবাদ প্রাপ্তির একমাত্র মাধ্যম ছিলো লোক মুখের শ্রুতি। বেশ কয়েক গ্রাম মিলে দু’একটি ট্রানজিস্টর(রেডিও) যদিও মিলতো। তাও সেগুলোর অনেকটা অকেজো বা ব্যাটারির অভাবে অলস পড়ে থাকতে দেখা যেতো। এদের মধ্যে যারা সংবাদ শুনতো তাদের মুখ থেকে শুনেই অন্যেরা তথ্যপুষ্ট হতো। যার ফলে অনেক সময় কোনো সংবাদ পেতে বেশ সময় লেগে যেতো। অথবা পেলেও সেই সংবাদ লোক মুখে সংক্ষিপ্ত বা আংশিক বিকৃত হয়ে পৌঁছতো।
এমন সংবাদই ছিলো অঞ্জনের গ্রাম্য চিকিৎসক বাবা অনিল বাবুর একমাত্র অবলম্বন। রেডিও কেনার সামর্থ্য নেই তাই সন্ধ্যার পর গ্রাম প্রধানের বাড়িতে গিয়ে বসে থাকতো সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার বিবিসি সংবাদ শোনার জন্য। দেশের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে কিছুদিন আগে থেকেই অঞ্জনের বাবা প্রাণ বাঁচাতে ভারতে শরনার্থী হবার কথা ভাবছিলো। কিন্তু গোপনীয়তার কথা বিবেচনা করে সে কথাগুলো কারও সাথে শেয়ার করেনি। সে অনেক বার ভেবেছে তার বন্ধুদের মতো মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবার কথা। কিন্তু তার পারিবারিক অবস্থা বিভিন্নভাবে তাকে অবিবেচকের মতো ঝুঁকি নেওয়া থেকে বিরত করেছে।
পরিবারে বৃদ্ধ অসুস্থ বাবা মা, এক ছেলে ও এক মেয়ের সংসারে তার স্ত্রী পুনরায় সন্তানসম্ভবা। অথচ পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম হলো সে। এমতাবস্থায় পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণ ও নিরপত্তার জন্য বিকল্প কেউ না থাকায় বুক ভরা দেশপ্রেম নিয়েও সবার কথা ভেবে তাকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এলাকার সবার সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক। তাই সে একবার ভাবে, ‘আমি তো কারো ক্ষতি কোনোদিন করিনি সুতরাং আমার কোনো ক্ষতি কেউ করতে পারে না। বাড়ি ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না।’ কিন্তু যখন সে লক্ষ্য করে যে, তার গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী সকল গ্রামের মানুষ (বিশেষ করে সংখ্যালঘু পরিবার) দলে দলে ঘর বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তার আত্মীয় স্বজন প্রায় কেওই অবশিষ্ঠ্য নেই, তখন সে মানসিকভাবে দূর্বল হয়ে পড়ে। সিদ্ধান্ত নেয় আগামীকালই রওনা হওয়ার।
পরিবারের সকলের সঙ্গে অঞ্জনকেও জানানো হয় যে তার মাসির বাড়ি যাওয়া হবে। অনিল বাবু তার মাকে বললে সে বলে, ‘বাবা আমি অসুস্থ হলেও যতোটুকু হাঁটতে পারি তোর বাবা তাও পারে না। ইন্ডিয়া অনেক পথ। পায়ে হেঁটে এতো পথ এখন আর আমরা যেতে পারবো না, বাবা। তার চেয়ে ভালো, কিছু চাল কিনে দিয়ে যাস, কচু শাক ভর্তা রেঁধে খেয়ে দিন কাটিয়ে দিবো। আর যদি মিলিটারি আসে তাহলে বলবো দু’জন কেই গুলি করতে। আমাদের তো সময় ফুরিয়ে এসেছে, তোদের সামনে অনেক ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। তোরা চলে যা, আমাদের কথা ভাবিস না।’
আজকের মতো এতো ভোরে অঞ্জনের কখনও ঘুম ভাঙেনি। তার মনে বেশ আনন্দ, অনেক দিন পর মাসির বাড়ি যাবে। সেই ছোট্টকালে একবার গিয়েছে যখন কিনা তার জ্ঞানই হয়নি। সে দেখে বাহিরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিন্তু পাশের রুমে গিয়ে দেখে তার অগেই তার বাবা মা উঠে টুকটাক ব্যাগ গোছাচ্ছে। মা বলল, ‘ঝটপট রেডি হয়ে নে বাবা।’ ঘুমঘুম চোখে অঞ্জন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, তারপর পাশের রুম থেকে কী যেন এনে নিজেই ব্যাগে ঢুকিয়ে দেয়। তার মা দেখতে পেলেও কোন প্রশ্ন করার মতো সময় তখন ছিলো না। সকলে রেডি হয়ে যখন বেড়িয়ে পড়ে তখনও ধ্রুব তারা অস্ত যায়নি। শুধু পায়ে হেঁটে এগিয়ে চলে তাদের পথ। সারা দিনে হেঁটে পৌঁছতে হবে একটি বাজারে, সেখান থেকে আরও দুটি যায়গায় অবস্থান করে অবশেষে একরাত্রিতে পার হতে হবে সীমান্ত। শুধু এতোটুকুই পথনির্দেশনা জানা আছে তাদের। পূর্ব আকাশ ফর্সা হয়ে আসে।
বড় রাস্তায় গিয়ে দেখে তাদের মতো অনেক পরিবার হেঁটে হেঁটে এগিয়ে চলেছে। অঞ্জনের পরিবারও একটি দলের সাথে গিয়ে মিশে যায়। মাথার উপর সূর্য ক্রমেই আগুন ঝরাতে থাকে। শরনার্থী দলের সঙ্গে পথ চলার মতো কঠিন কাজ নেই। ছোটরা তো দূরের কথা বড়রাও দলের সঙ্গে হাঁটতে হিমশিম খায়। অঞ্জনের ছোট দুটি পায়ে ফোসকা পড়ে যায়। জামা ভিজে যায়। খুলে নেয় হাতে তাতেও রক্ষে হয় না। অঞ্জনের উৎসাহে ভাটা পড়ে। চলতে চলতে ভাবতে থাকে এতো কষ্ট জানলে সে আর মাসির বাড়ি যেতে চাইতো না। তার দিদি মৌসুমীও এতোটা ক্লান্ত হয়ে পড়ে যে, সে বলে আর হাঁটতে পারবে না। বাধ্য হয়ে তার বাবা তাকে ঘাড়ে তুলে নেয়, সঙ্গে দু হাতে দুটি ব্যাগ তো আছেই। অঞ্জনের যা দরকার ছিলো তার দিদি সে সুযোগ গ্রহণ করায় কষ্ট করে হলেও সে হেঁটে চলে। জৈষ্ঠ্যের তপ্ত রোদে মাথা ঝিম ঝিম করতে থাকে। এক সময় চোখ তার অন্ধকার হয়ে আসে। চুপটিকরে বসে পড়ে ধুলো মাখা মেঠো পথের মাঝে। তার বাবার আর পেছনে তাকানো হয়ে ওঠেনি। সবাই এগিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর তার মা পেছনে তাকিয়ে লক্ষ্য করে অনেক পেছনে অঞ্জন মাটিতে বসে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে কিন্তু মুখে কোনো শব্দ নেই। অঞ্জনের মা চিৎকার দিয়ে ওঠে বলে, ‘এই দেখো গো আমাদের অঞ্জনের কী যেন হয়েছে, সে পেছনে ছাড়া পড়েছে, আমরা খেয়ালই করিনি।’ তার বাবা এগিয়ে যেতেই পেছনে এগিয়ে আসা একজন লোক তাকে কোলে তুলে নিয়ে এগিয়ে আসে। অবশেষে সেই লোকটির কোলে চড়েই প্রথম গন্তব্যে পৌঁছে অঞ্জন।
একটি স্কুল ঘরের বারান্দায় কাটে তাদের প্রথম রাত। স্কুল ঘরটি কোনো ক্যাম্প না হলেও শরনার্থীদের নিয়মিত অবস্থনের ফলে সেটি অস্থায়ী ক্যাম্পের রুপ নিয়েছে। সজাগ নিদ্রার মধ্যে দিয়ে রাত কাটিয়ে শুরু হয় পুনরায় অভিযাত্রা। গায়ে পায়ে ব্যথা নিয়ে পর পর দু’দিন রাত্রিকালীন বিরতি দিয়ে আবশেষে একটি বাজারের কাছে একটি বড় কড়ই গাছের নিচে আশ্রয় নিয়ে চলে রাতের জন্য অপেক্ষা। কারণ এবার সীমান্ত পার হবার পালা। কিছুটা শীথিলতা থাকলেও দিনের আলোতে জনগনের সীমান্ত পারাপারের বিষয়টি কোন রাষ্ট্রেরই নিয়মের মধ্যে পড়ে না, তাই সমস্ত রাত্রি জুড়ে চলে যতো পারাপারের ব্যাস্ততা। দিন হলেই সব কিছু স্বাভাবিক।
পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত পার হবার রাতে অঞ্জনের ঘুম ভেঙে যায় মানুষের কোলাহলে; তখর রাত তিনটে। দেখে সকল শরনার্থী যেন ছোটাছুটি করছে কার আগে কে যাবে। কেউ গরুর গাড়িতে কেউ পায়ে হেঁটে। এখানে সামর্থের চেয়ে বড় বিষয় হলো সহজপ্রাপ্যতা এবং ভাগ্য। অঞ্জনের বাবা-মাসহ সবাই প্রস্তুত কিন্তু অঞ্জনকে ডাকা হয়নি কারণ তারা বড় যে কড়ই গাছের নিচে আশ্রয় নিয়েছিলো সেখানে রাতের ঠান্ডা বাতাসে সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলো। অনিল বাবু অনেক চেষ্টা করেও একটি গরুর গাড়িতে ওঠার ব্যবস্থা করতে পারলো না ফলে তাদেরকে হেঁটেই যেতে হবে। তাই দেরী করে কী লাভ? রাত্রি সড়ে তিনটার দিকে তারা হেঁটে রওনা দিলো, উদ্দেশ্য ভোরের আগে সীমান্তে পৌঁছানো। আকাশে চাঁদের দেখা না থাকলেও তারার অভাব নেই। সমস্ত আকাশ যেন ঝিকমিক করছে। কিন্তু নিচে আলোর কোনো ঝিকমিক নেই। কারণ আলো নিভিয়ে পথ চলতে হচ্ছে। অজানা এক ভয় ঘিরে রেখেছে সবাইকে। এই বুঝি পাকিস্তানি মিলিটারিরা পথ রোধ করে দাঁড়াবে। বেঁচে থাকার শেষ আশাটুকু এই বুঝি শেষ হয়ে যায়। পথে শুধু পথিকের পায়ের শব্দ আর গরুর গাড়ির কচকচানী শব্দ। আর এক ধরণের শব্দ আছে যেটি কানে শোনা যায় না শুধু উপলব্ধি করতে হয়। দিগন্ত জোড়া শব্দ, মাঠ ঘাট পথের ধুলার প্রতিটি কণায় যেন প্রতিদ্ধনি হয়ে ফেরে; সেটি হলো, শরনার্থী মানুষের বুক ফাটা আর্তনাদের শব্দ।
শরনার্থীদের পথ চলা মানে রুদ্ধশ্বাসে হেঁটে চলা। নেই কোনো দিকে তাকানোর সময়, কোনো কিছু ভাবার সময় বা একটু বিশ্রাম নেবার সময়। অঞ্জন বুঝতে পারছে তার এ যাত্রা কোনো স্বাভাবিক যাত্রা নয়। সবার চোখে মুখে যে ভয়, আতঙ্ক, আর উৎকণ্ঠা, তা স্বাভাবিকভাবে অঞ্জনকেও গ্রাস করে ফেলেছে। মাসির বাড়ি যাবার ইচ্ছা তার অনেক আগেই উবে গেছে। একেতো গভীর রাত তার উপর মাটির রাস্তা। অঞ্জনের ছোট ছোট পা দুটি কোনো ভাবেই তাল মেলোতে পারছিলো না। উঁচু নিচু মাটি। গরুর গাড়ির চাকার প্রভাবে রাস্তার মাঝখানদিয়ে গভীর নালা তৈরি হয়েছে। বড়দের পক্ষেই সেই পথ চলা কষ্টকর। সে কারণে অঞ্জনের বাবা দ্রুত পথ চলার স্বার্থে এবার অঞ্জনকে ঘাড়ে নিয়ে পথ চলতে শুরু করেছে।
ঘামে ভেজা কাঁধের উপর বসে অঞ্জন ভাবছে বিচিত্র সব কথা। মাঝে মাঝে সে আকাশের তারা গুণছে। দেখছে তার বাবার দেখানো বিভিন্ন তারার প্যাটার্ন। সবার চেয়ে উঁচুতে বসে সে নিজেকে তারার সাগরে কল্পনা করছে। হালকা বাতাসে ধোঁয়ার গন্ধ, তার চেয়েও তীব্র গন্ধ নাকে আসছে তার বাবার গায়ের ঘামের গন্ধ। দুই হাতে দুটি ব্যাগ তার উপর ঘাড়ে অঞ্জন। তার মায়ের এক হাত ধরে চলছে তার দিদি অপর হাতে ব্যাগ।
এক সময় তারা পৌঁছে গেলো সীমান্তে। দেখা গেলো এতো প্রতীক্ষিত সীমান্ত আহামরি কিছু নয়। মাঠের মাঝে একটি ছোট নালা তাও সেটি জল বিহীন। সেই নালা পার হলেই নাকি অন্য দেশ অর্থাৎ ভারত। সকল শরনার্থীর কাছে সেই নালা কোন নালা নয়; সেটি যেনো রামায়ণের লক্ষণরেখা, যার বাহিরে এতোক্ষণ সবাই অবস্থান করছিলো। অবশেষে ভয়ে দুরুদুরু বুক নিয়ে দ্রুতবেগে নালা পার হয়ে গেলো সবাই।
উদ্বিগ্নতা আর অনিশ্চয়তার মধ্যেও একটু স্বস্তি অনুভব করতে লাগলো সবাই। অদূরে একটু উঁচু স্থানে শত শত মানুষ। একটা বড় টিনের তৈরি ঘর, একসময়কার গোডাউন হয়ে থাকতে পারে সেটি। ভেতরে কোন মালামাল নেই তার পরিবর্তে মানুষে ঠাসা, বাঁকিগুলো তারই আশপাশে। যারা রাতে সীমান্ত পার হচ্ছে তারা সবাই সেখানে গিয়ে জমায়েত হচ্ছে। অপেক্ষা সূর্য ওঠার। তখনও সকাল হতে বেশ খানিকটা দেরী। ক্লান্ত শরীর আর ভোরের ঠান্ডা বাতাসে অনেকেরই চোখ জুড়ে এসেছে ঘুম। কেউ গাছের তলায় কেউবা খোলা আকাশের নিচেই কাপড় বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কেউ স্বজন হারানোর, কেউবা স্বজনদের ফেলে আসার কষ্টে শুধুই কেঁদে চলেছে। অঞ্জনের পরিবার কোন রকমে গোডাউনের বাহিরে টিনের দেয়াল ঘেঁষে বসে একটু ঝিমাতে লাগলো।
ভোরের আলো ফুটে উঠলো। এ যেন অন্যরকম ভোর। আজ অঞ্জনের ঘুম সবার আগেই ভেঙেছে। অঞ্জন দেখছে চারদিকে ঘুরে ঘুরে। এটি ইন্ডিয়া? এটি বিদেশ! জ্ঞান হবার পর জীবনে প্রথম দেশের বাহিরে পা রেখেছে সে। কিন্তু হায়! এতো আমাদের দেশের মতোই সবকিছু। মনে মনে ভাবতে থাকে অঞ্জন। কোন পার্থক্যই চোখে পড়ে না তার। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রাকের শব্দ কানে আসে অঞ্জনের। গ্রামের ছেলে তাই দৌড়ে ছুটে যায় ট্রাক দেখতে। এবারে সে একটু পার্থক্য খুঁজে পায়। ট্রাকের গায়ে ভারতের পতাকা। তার বাবা বাড়িতে দেয়ালে একটি ওয়াল্ড ম্যাপ টানিয়ে রেখেছে যার নিচে অনেকগুলো দেশের পতাকার ছবি আছে। অঞ্জন মাঝে মাঝে পতাকাগুলো দেখে বেশ কিছু দেশের পতাকা মুখস্ত করে ফেলেছিলো। পেছন থেকে ডাক আসে, ‘অঞ্জন তাড়াতাড়ি এদিকে আয় বাবা একটু মুড়ি খেয়ে নে, গাড়ি এসে গেছে, আমাদের এখনি যেতে হবে।’
ট্রাকে বসার কোনো ব্যবস্থা নেই। তাতে কী? উপচে পড়া যাত্রির চাপ। অল্প সময়ের মধ্যে গাড়ি পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। দুটো গাড়ি ছাড়ার পর তৃতীয় গাড়িতে উঠতে পারলো অনিল বাবুর পরিবার। গন্তব্য পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাট নামে একটি শহর। ট্রাকের ক্যারিয়ারের উঁচু দেয়ালের মধ্যে গাদাগাদি করে অনেক মানুষ। রাস্তা খুব একটা ভালো নয় তার উপর তীব্র রোদ আর গরমে যা হবার তাই মেনে নিয়ে সবাই চলল। পথে কেউ কেউ নেমে গেলো। কেউ গেলো ক্যাম্পে কেউ তাদের কোন দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়ি। পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের কাছাকাছি বিস্তৃর্ণ অঞ্চল জুড়ে পশ্চিম বঙ্গে ছড়িয়ে রয়েছে ক্যাম্প। প্রায় ঘণ্টা খানেক পরে তাদের গাড়ি গিয়ে পৌঁছলো বালুরঘাট শহরে।
শহর না বলে শহরতলী বলাই ভালো। ছোট্ট জীবনে অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতাই হলো অঞ্জনের। একটি ঠেলা গাড়িতে চেপে তারা অবশেষে পৌঁছলো তাদের রিলেটিভের বাড়ি। এখানে উল্লেখ্য যে, যেসকল শরনার্থী সেখানে গেছে বলতে গেলে তাদের সবারই কোন না কোন আত্মীয়-স্বজন তাদের পরিবার নিয়ে শরনার্থী হয়েছে কিন্তু তারা কেউ জানে না কে কোথায় আছে।
মাসির বাড়ি প্রবেশ করার আগেই অঞ্জন দেখতে পেলো বাড়ির পাশে কিছু মানুষ খোঁড়াখুড়ি করছে। প্রায় প্রতিটি বাড়ির পাশেই মাটিতে গর্ত বা মাটির স্তুপ। কোন কোন বাড়িতে গর্ত খোঁড়া হয়ে গেছে কোন বাড়িতে কাজ চলছে। কেন এতো খোড়াখুঁড়ি তা অঞ্জন জানে না। মূলত স্থানীয় বিএসএফ প্রশাসন এবং ইন্ডিয়ান আর্মিদের পক্ষ থেকে প্রতিটি পরিবারকে বাঙ্কার খুঁড়তে বলা হয়েছিলো। কীভাবে সেটি তৈরি করতে হবে সে ট্রেনিংও দেওয়া হয়েছে। যখন বিএসএফ এর পক্ষ থেকে শেল (সে সময় বোমাকে শেল বলে অবিহিত করা হতো) নিক্ষেপ করা হতো তখন এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী শেল নিক্ষেপ করে তখন তার প্রভাব থেকে বাঁচার জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো। কোনো বাঙ্কার ‘W’ আকৃতির, কোনোটি ‘U’ আকৃতির, আবার কোনটি ‘Z’ আকৃতির। এক মানুষ সমান গভীর ও বেশ প্রশস্থ বাঙ্কার সেগুলো। উপরে কাঠ বা বাঁশের সাহায্যে ঢাকা। যখন পূর্ব পাকিস্তান থেকে শেল নিক্ষেপ করা হয় তখন শাঁ শাঁ করে একটা শব্দ হয়। অথবা বিএসএফ যখন শেল নিক্ষেপ করবে তখনও কিছু সংকেত ব্যবহার করে যা শোনা মাত্রই মানুষজন দ্রুত গিয়ে বাঙ্কারে প্রবেশ করে। নিরাপদ মনে করলে পুনরায় সবাই বেরিয়ে আসে। যখন স্বাভাবিক অবস্থা থাকে তখন ছোট ছোট বাচ্চারা সেই বাঙ্কারের মধ্যে গিয়ে খেলাধুলা করে।
অঞ্জনের মাসির বাড়ির খুব কাছাকাছি বেশ কয়েকটি শেল পড়েছে এ ক’দিনে। বাড়িঘর ভেঙেছে, ভেঙেছে দোকান ও গ্রাম্য চিকিৎসা কেন্দ্র।
একদিন খুব সকাল থেকে শেল নিক্ষেপ শুরু হলো। সকালে লোকজনের খাওয়া হয়েছে কি হয়নি। সবাই ছুটে গিয়ে বাঙ্কারে প্রবেশ করলো। দীর্ঘ সময় চলছে গোলাগুলি। আজ যেন থামার কোন লক্ষন-ই দেখা যাচ্ছে না। মানুষজন বাঙ্কারে ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে চুপটি করে বসে আছে। কারও মুখে নেই কোনো কথা। কিন্তু এতো দীর্ঘ সময় বাচ্চারা কি ধৈর্য্য ধারণ করতে পারে? তারা অধৈর্য্য হয়ে উসখুস শুরু করে দিলো। একাধিক বাচ্চা অঞ্জনদের সেই বাঙ্কারে থাকায় তারা পরস্পর গুতাগুতি চিমটাচিমটি শুরু করে দেয়। কখনও বা সুন্দর করে পরস্পর খেলছিলো। অঞ্জনের মাসতুতো দুই ভাই ও এক বোন এবং তার দিদি মিলে মোট পাঁচজন বাচ্চা বেশ মজা করে খেলছিলো। বড়রা তাদের স্মৃতি মন্থনসহ দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলছিলো। হঠাৎ করে বিকট একটি শব্দ। বুঝতে বাঁকি রইলো না যে খুব কাছেই শেল পড়েছে। কোথায় পড়লো এ নিয়ে যখন বড়রা নিরীক্ষণ শুরু করেছে ঠিক সে সময় অঞ্জনের মা খেয়াল করে যে তার ছেলে বাঙ্কারে নেই। মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, ‘মৌসুমী, তোর ভাই কই?’
ভাইতো মার্বেল আনতে গেছে।
কোথায় মার্বেল আনতে গেছে?
কেন আমাদের থাকার ঘরে, মাসিদের বাড়ি।
অঞ্জনের মায়ের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। ‘কী বলিস, কখন গেলো? আমিতো এই মাত্র ওকে এখানে খেলতে দেখলাম।’ বলেই ছুটে বেরিয়ে যায় সে। বাড়ি থেকে বের হবার সময় অঞ্জন ব্যাগের মধ্যে তাহলে কী ঢুকিয়ে দিয়েছিলো সব কিছু পরিস্কার হয়ে যায় তখন। বাহিরে গিয়ে দেখে বেশ কিছু মানুষ হৈচৈ করছে এবং একত্র হয়ে কী যেন দেখছে। কাছে যেতেই দেখতে পায় অঞ্জনের নিথর দেহ পড়ে রয়েছে ঠিক রাস্তার মাঝখানে। শুধু রক্তে লাল হয়ে যাওয়া রাস্তার কালো পিচের মাঝে পড়ে থাকা লাশের চারিদিকে মুক্তোর মতো জ্বলজ্বল করছে অঞ্জনের কাঁচের মার্বেলগুলি।