মায়ের চোখ দুটো স্বচ্ছ জলে টলটল।দুপাশে জলের ধারা নেমে গেছে কপোল বেয়ে। ছোটবেলায় দেখা মামা বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা মৃতপ্রায় নদীর স্বচ্ছ জলের ধারার মতো সে ধারা থেমে থেমে বয়ে চলে অবিরাম। অর্ণা নদীর সে ক্ষীণ ধারায় বাটি চুবিয়ে গা ভিজিয়েছে কত!
মায়ের চোখের সে জলের ধারা, দাগ, কেউ দেখে না । অর্ণা দেখে। অর্ণা মায়ের চোখের জলের ধারা মুছে দিতে পারে না। নদীর ধারার মতো বয়ে চলে নিরন্তর । মা অর্ণাকে, অর্ণা মাকে জড়িয়ে রেখে দুজন একাত্তরেই বিচরণ করে নিশিদিন।
“মা, মাগো!”
অর্ণা কিছু জানতে মাকে ডাকে।
ইউক্যালিপটাসের মতো সাদা গোড়ালিযুক্ত ত্রস্ত পা ওখানেই থেমে যায়।
কাঁকনহীন নিটোল হাত কেঁপে উঠে।
কানের লতি অব্দি ছাঁটা অবিন্যস্ত চুলের উপর থেকে ঘোমটাটা আতঙ্কে সরে গেলে ধবধবে পাণ্ডুবর্ণ মুখটা আরো খানিকটা ফ্যকাসে হয়ে যায়।
যখন দেখে মেয়ে ঠিক আছে, তখন বলে –
“এমন ভাবে ডাকছ্স না,আমি ভাবছি,কি না কি!”
কি না, আবার কি ই তো।বাবার একক একটা ঝকঝকে ছবি। বাবা হারা মেয়ের দেখার ইচ্ছে তো জাগতেই পারে।
” মা, বাবার কোন ভালো ছবি নেই কেন?একা,কিংবা তুমি আর বাবা, তোমাদের কোন প্রিয় মুহুর্তের ছবি!”
“আছে তো ছবি।”
বুকের ভেতর ছবি মেয়েকে কী করে খুলে দেখায়!
মা যেন কোন এক ঘোরের জগতে থাকেন।
অনেক কথা,প্রশ্নের উত্তর মা কোন এক ঘোরের জগৎ থেকে দেন।
“আছে ছবি!দেখাও তো নি কোন দিন।”
“না,আদতে নেই।তখন এত ছবি তোলার রেওয়াজ ছিল না রে।”
লোকটার কত বর্ণনা তো মেয়েকে দিছে কত বার!
মেয়ে কি তার বাবার ছবি আঁকে নাই হৃদয়ে?
-আমরার বিয়ের ছবির রিলগুলো জ্বলে গেছিল গা। যা দু একটা ছিল প্রিন্ট করা তো অয় নাই।
এত গন্ডগোলের মধ্যে কি কিছৃ অয়?বিয়েডাই তো অইছে -উঠ ছেড়ি তর বিয়া।বাপ মা মরা ছেড়ির মামারা ভাবছে-আপদ বিদায় করি!তুই আছস ছবি লইয়া!রিল,ক্যামেরা,ঘরবাড়ি জীবন, শরীর সবতো লাইনে খাঁড়া কইরা গুলি করছে।
-মা!
কইতে না করস্ কিয়া?মৃনাল ভট্টাজ্জি তো বাংলা ঘরে বইয়া কইছে।উনি তো দালাল গুলাইনরে চিনে! তাইন তো গুলি করার আগেই পইড়া গেছিল। কেন রে, তর বাপ পারে নাই ? ভট্টাজ্জির লাহান গুলির আগেই পইড়া যাইতে!
অর্ণা বুঝে, মা ঘোরে বকছে।মাকে জড়িয়ে ধরে অর্ণা।
একটা সাদা কালো গ্রুপ ছবি অবশ্য আছে-
নোয়াব আলী চাচা
প্রানেশ কাক্কু।
হরিমোহন কাক্কু।
একবারে বা পাশে আলামীন চাচা।তার ডানে অর্ণার বাবা অঞ্জন রায়।
বহু দিন বড় ঘরে অন্য ছবির সঙ্গে টাঙানো ছিল।রঙ চটা হয়ে অবয়ব চেনা যায়না।আলামীন কাক্কুকে অর্ণা দেখেছে বলে চিনতে পারে।বাবার মুখের জায়গাটা নষ্ট হয়ে গেছে। বড় ঘর থেকে এ ছবিটা নামিয়ে নিজের ঘরে ঝকঝকে করে রাখার ইচ্ছে ছিল অর্ণার মা রাঙা বউয়ের।অর্ণা ছবিটা নামিয়ে নিজের ঘরে রাখে।
আলামীন চাচাকে কতবার দেখেছে অর্ণা!
আসতেন। বাবার গল্প করতেন।
আমারে কইলো-নিরঞ্জন দা তো ওই পাড়ে গেছেগা,ট্রেনিং লইতে। বউ পোয়াতি,বাবা মা তো রিফিউজি অইতে চায়না।কি যে করি!যাইতে তো অইবোই। তরা যা, আমি ইকটু গুছাইয়া আইতাছি।
তার আর যাওয়া অইলোনা।এলাকায় অপারেশনের আগেই তো সব শেষ!
আলামীন চাচার দীর্ঘ ভারি নিশ্বাস ছড়িয়ে থাকে চারদিকের বাতাসে। অর্ণা সে বাতাসে বাবাকে খুঁজে পায়।
আলামীন চাচা কখনো বলতেন-
বুঝলা ভাতিজী।
যুদ্ধ যেমন দেহা যায় তেমনি কোন কোন যুদ্ধ দেহা যায়না,অদৃশ্যও বটে।
অদৃশ্য যুদ্ধটা ভেতরে ভেতরে চলে-চলতাছে।
অর্ণা কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করতো-সেটা কিভাবে কাকু?
-শোন,একটা দৃশ্যমান যুদ্ধে অগণিত আশা-আকাঙ্ক্ষা থাহে, স্বপ্ন থাহে।কোন কোন প্রশ্নে,অবস্থায় প্রেক্ষিতে
দৃশ্যমান যুদ্ধটা কারো কারো কাছে শেষ অইলেও আদতে যুদ্ধ শেষ অয়না।শুধু যাদের আকাঙ্ক্ষার শেষ অয়,স্বপ্ন পুরণ অয়,যারা যুদ্ধ থেকে কিছু পাইয়া যায়,তাদের কাছে যুদ্ধ আর রাজনীতি শেষ অইয়া যায়।তাদের কেউ কেউ আবার
যুদ্ধের শত্রুদের সঙ্গে আত্মীয়তা করে,চলাফেরা করে, এক মঞ্চে বইস্যা কোরাশ গায়।
অদৃশ্য যুদ্ধটা শুরু অয় তহন।যাদের স্বপ্ন পুরণ অয়না তাদের কাছে যুদ্ধ শেষ অয়না।তাদের যুদ্ধটা চলতে থাহে, রাজনীতিটা চলতে থাহে।খাইট্টা খাওয়া সাধারণ মানুষ ভালো কইরা বাঁচার আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে,শোষণমুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে একাত্তরে যুদ্ধ করছিল,তাদের যুদ্ধ তো শেষ অয় নাই মা।যারা শত্রুর সঙ্গে আপোস করেনা,তারা জনগণ। ভেতরে ভেতরে তাদের যুদ্ধটা চলে-চলতাছে।
তাহলে আমরা কী প্রতিনিয়ত যুদ্ধের ভেতর দিয়েই চলছি কাকু!
হ্যাঁ মা,এইডা শোষণমুক্তির যুদ্ধ।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আলামীন এঁর মুখে এসব কথা শুনে কেউ কেউ তাকে পাগলা ক্ষেপাটে ভেবে হাসে।অর্ণা নেগেটিভ ভাবে দেখেনা। আলামীন চাচার বোধ, চেতনা অহংকার আর, মাথা নত না করাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে সে।
তাঁর কথাগুলো অর্ণাকে ভাবায়।
এখন অব্দি চলা যুদ্ধের পুরো গল্পটা অর্ণার জানা হয়ে গেছে-
রাতে টানা বৃষ্টির পরও আকাশে মেঘ। রোদ উঠেনি।ম্যাড়ম্যাড়ে ভেজা সকাল।রান্নাঘরে রান্না করছে রাঙাবউ। চুলা থেকে ধোঁয়া উঠছে বলে জ্বালা করা নাক চোখ থেকে জল ঝরছে অবিরত।স্বাভাবিকের চেয়ে থমথমে পরিস্থিতিতে যথেষ্ট চুপচাপ থেকে বাড়িতে যে যার মতো কাজ করছে।
দুর্বা ঘাসে ভরা পায়ে চলা পথে দোআঁশ মাটির চপচপে কাদার উপর তালে তালে পা ফেলা কোন ভয়ংকর আওয়াজ কারো কানে এসে পৌঁছায়নি তখনও। বাড়ির পাখপাখালিরা হঠাৎ খুব চঞ্চল হয়ে উঠে।বাঁশঝাড়, ঝোপঝাড়, ফলের বাগান, বনজ বৃক্ষ, সব মিলিয়ে গাছ গাছালি তো কম নয়।তাই বলে এত পাখি বাড়িতে! এ দুঃসমযে একনাগারে কাকেদের কা-কা আর্তনাদে বাড়ির মানুষগুলো যেন অশনি সংকেত শুনতে পায়। একেকজন অন্যজনের মুখের দিকে তাকায়। কিছু একটা তো হতেই চলছে।কিছুটা কী? ভয়ংকর নাতো! মুহূর্তেই পাখিদের-কাকেদের আর্তনাদ থেমে গিয়ে বাড়ির দিকে ধেয়ে আসা অসংখ্য বুটের আওয়াজ বাড়িটাকে স্তব্ধ করে দেয়। অঞ্জন রায় দেউরির মুখে এগোয়-উদ্ধত বুট আর বেয়নেট এত কাছে! দ্রুত পেছন ফিরে বাড়ির ভেতর ইশারা করে।জল্লাদগুলো তাকে ঘিরে ধরার আগেই এর বেশি কী করার আছে তার?
আঁশটেশালা,ঝোপঝাড়, বেতঝাড়ের কাটা,কঞ্চির স্তুপ পেড়োলেই ঘন জঙ্গল। ঝোপঝাড়ের নিচে গর্তগুলো এক একটা বাঙ্কারের মতো।একাত্তরে এদেশের গ্রাম-গঞ্জের জঙ্গলগুলো সেইফ সেন্টারের মতো কত লোকের জীবন আগলেছে!বাড়ির মেয়ে বুড়ো সকলে দৌড়ে গিয়ে সকল সর্বনাশের আশা নিয়ে দিনভর জঙ্গলের ওই প্রাকৃতিক বাঙ্কারগুলোতে স্তুপের মতো গুটিয়ে বসে থাকে।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর রাতের আঁধার নেমে এলে অতি সতর্কভাবে কচ্ছপের মতো গলা বাড়িয়ে একে একে বেরিয়ে এসেছে জঙ্গল থেকে। বাড়ি ততক্ষণে লুট হয়ে গেছে।ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা জিনিসপত্রের পাশে, ঘর, উঠোন,চৌকাঠ, বাইর বাড়ি সব জায়গায় তন্ন তন্ন করে বিনোদ রায় ছেলের লাশ খুঁজে।না পেয়ে সাময়িক স্বস্তি পেয়েছে-যাক,হয়তো বেঁচে আছে, হয়তো…।
পরের সময়টুকু মহা তান্ডব-অন্তত অর্ণার মায়ের জন্য বিভীষিকা।
অঞ্জন রায়কে ধরে নিয়ে যাওয়ার চাক্ষুষ সাক্ষী আছে।
তারপর?
তারপর?
আন্দাজে কেউ কিছু বলে,অথবা কেউ জেনেও কিছু বলে না।
ফিরবে কি ফিরবে না!অনিশ্চিত চোখে রায় বাড়ির লোকেরা অপেক্ষা করে।
যারা নিশ্চিত ছিল অঞ্জন রায়ের পরিনতি সম্পর্কে , তারা হায়েনার মতো ফিরে ফিরে এ বাড়িতে আসে।
“আফনের রাঙা বউরে আমরার ছেড়ার কাছে হাঙ্গা দেইন।যা দিন পড়ছে,না অয় ক্যাম্পে উডাইয়া নিবো। তার চেয়ে তো আমরা নিরাপদ!”অর্ণার ঠাকুমা-ঠাকুর্দার কাছে প্রস্তাব আসে।একটার পর একটা এমন আপত্তিকর প্রস্তাব আসতেই থাকে।
ভারতের রিফিউজি ক্যাম্পে যাওয়া নিয়ে বিনোদ রায়ের ওজর আপত্তি নেই আগের মতো।
তবে ওদের চোখ এড়িয়ে পাহাড়ি পথ ধরে ওপারে রিফিউজি ক্যাম্পে পৌছা অসম্ভব। রাঙাবউ গর্ভবতী ।নিরঞ্জন রায় যুদ্ধে, নিরঞ্জন রায়ের বউ বাবার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে আটকে গেছে।এখন ছেলেকে নিয়ে শরনার্থী শিবিরে।বিষয়টা নিয়ে পাকিস্তানি দালালদের নানা তল্লাশি, চাপ চলছেই।
” বউমাতো পোয়াতি, কয়ডা দিন যাউক,আবু খালাস অউক,হাঙ্গা-বিয়া দিয়াম নে তোমরার লগে।হেই অব্দি আমার বউমার কোন ক্ষতি কইরোনা তোমরা।”অর্ণার ঠাকুমার রণকৌশল এটা।
ভেতরে ভেতরে পালানোর পথ খোঁজে তারা।
ততদিনে মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নিয়ে ফিরেছে।একটার পর একটা সফল অপারেশনে হায়নাগুলো লেজ গুটাচ্ছে।
যুদ্ধের পর আরেকটা যুদ্ধ।
চৌকাঠ পেড়োলে উঠোন,দেউড়ি পেড়িয়ে বাইর বাড়ি হেঁটে গেলে পুকুর ঘাট।কলতলা,রান্নাঘর, নিজের শোবার জন্য কোঠাঘর, মাথায় লম্বা ঘোমটা টানা রাঙাবউয়ের এই হল জীবনের চৌহদ্দি।এই চৌহদ্দির ভেতরে মায়ের টিকে থাকার সংগ্রামটা অর্ণা দেখেছে।
মানুষ আশাহীন বাঁচেনা।
তাহলে কী ছিল তাঁর জীবনের প্রেষণা?
ক্রমশ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে থাকা কিছু টুকরো স্মৃতি, সামান্য দাম্পত্য সময়কে নিয়ে কেউ কাটিয়ে দিতে পারে সারা জীবন?
কেন এই মেনে নেয়া?
পড়াশোনা জানা মেয়ে নতুন স্বপ্ন,নতুন আশা নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতেই পারতো।মায়ের এ ত্যাগ অর্ণার জন্য?তিনি কী বাধ্য ছিলেন এখানে থেকে যেতে? সন্তান তাহলে কি মায়ের জীবনের জন্য কখনো স্বাধীন ভাবে চলার পথে বাধা?
না কি সে একজন আদর্শ নারী হতে চেয়েছিল?তাই তাকে চৌহদ্দি ভেতর থাকতে হতো?তাকে সব মেনে নিতে হতো?সংসারের সকল কাজ করতে হতো?
মায়ের জীবন নিয়ে প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি আজ অর্ণা।
রায় বাড়ির বিরাট প্রোপার্টির কোন রকম উত্তরাধিকারি অর্ণা কিংবা রাঙাবউ নয়?কেন?
মায়ের কোন ছেলে সন্তান হলে?
ঠাকুরদা মায়া করছেন যথেষ্ট। দশ কাঠা ধানি জমির দানপত্র দলিল রাঙাবউয়ের জাতে তুলে বলেছেন “বউমা, প্রচলিত আইনে তুমি আর তোমার ছেড়ি তো কিছু পাইতো না,তাই আমি কিছু দিলাম তোমারে।”
ঘুমটার আড়াল থেকে মায়ের ক্ষীণ কন্ঠের কোন প্রতিবাদ দাদুর কানে পৌছে ছিল কি না অর্ণার জানা নেই, তবে অর্ণারা আজ মিছিলে স্লোগানে নারীদের উত্তরাধিকার নিয়ে জোড়ালো আওয়াজ তুলছে।
দাদু গত হয়েছেন।
নিরঞ্জন রায় যুদ্ধের পর সমসাময়িক রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত ।
নিরঞ্জন রায়ের ছেলেদের বিশেষ কোটায় চাকরি হয়েছে। ছেলে বউ নাতী নাতনি নিয়ে পয়মন্ত সংসার।
সংসারের কাজে কর্মে রাঙাবউ আর আবশ্যকীয় নয়।
আলামীন চাচার কথা খুব মনে হয় অর্ণার-
সার্টিফিকেট নেন নি।
ভাতাটা তুলতেন না বলে অভাবের সংসারে বউ বাচ্চাদের লাঞ্চনা গঞ্জনা সইতে হতো।চাচি কথায় কথায় আলামীন চাচার বলা কথাগুলি ভেঙিয়ে বলে
খোটা দিতো “তাইনের তো যুদ্ধ শেষ অয় না,তাইন তো ভাতা নিতে,পুরষ্কার নিতে পারেন না।তাইনের যুদ্ধ তো চলতাছে।”
রাঙাবউয়ের ছেষট্টি।
অর্ণার একান্ন।
দুজন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করে।
আলামীন চাচার কথাই হয়তো ঠিক ।কারো কারো যুদ্ধ শেষ হয়না,ভেতরে ভেতরে সংগ্রামটা চলতে থাকে।
রাঙাবউয়ের খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসা বাসন্তী এখন অর্ণার কাঁধে হাত রেখে নতুন স্বপ্ন দেখে।