এত দেরি করে কেন এলে তুমি ঈশ্বর?
বিগত জন্মের সব পোড়া দাগ আর কালশিটে নিয়ে তোমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলাম।
হাতে-পায়ে, ঠোঁটে, গালে, শিরায়, উপশিরায়, স্নায়ুতে, রোমকূপে লেগে ছিল…
ফেলে আসা জীবনের নর্দমার গন্ধ।
তুমি হাত বাড়ালে, আমি আঁকড়ে ধরলাম
মাথায় রাখলে হাত, আমি জড়িয়ে ধরলাম।
তুমি অভয় দিলে, আমি কেঁদে উঠলাম
তুমি অবয়ব দিলে, আমি জন্ম নিলাম।
সেদিন প্রথম দেখা তোমার মুখের আলো।
মানুষ আর পৃথিবীর প্রতি প্রচণ্ড অনীহা,
অবিশ্বাস আর ঘৃণায় পচে যেতে যেতে আমি-
আবার নতুন করে জেগে উঠলাম।
নতুন করে বাঁচার লোভ হলো।
নতুন করে স্বপ্ন দেখলাম।
নতুন করে ভালোবাসার শক্তি পেলাম।
সেদিন প্রথম তোমাকে জড়িয়ে ধরা….
সেদিন প্রচণ্ড ডুকরে বলতে ইচ্ছে করেছিল,
“এত দেরি করে কেন এলে তুমি ঈশ্বর?”
প্রতিপক্ষের প্রতি
মাঝে মাঝে প্রতিপক্ষের জন্যে মায়া হয়।
কষ্ট জাগে, কান্না পায়।
মনটা বলে, “আয় রে তোকে জড়িয়ে ধরি।
বুকের সাথে লেপটে ধরি, ঘন করে ফেলি শ্বাস।”
প্রতিপক্ষের জন্য ভীষণ দুরদুর করে বুক।
ভাবি, যদি পারতাম,
তার নিচু হয়ে যাওয়া মাথার ওপর হাত রাখতে,
থুতনিটা ধরে তুলে ধরতাম তার বিষণ্ন মুখ।
ইচ্ছে করে নিঃশব্দ কান্নার অশ্রুফোঁটাগুলো তার
মুছে দিই আঙুল দিয়ে।
চুমু খাই তার কপালে।
নরম করে চোখের দিকে তাকিয়ে বলি,
“হ্যাঁরে, তোর ক্লান্ত লাগে? তোর মন খারাপ?
কেমন আছিস তুই?”
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে তাকে বলি,
“আর কত করবি লড়াই?
যে লড়াইয়ে তুই হাঁসফাঁস, আমিও তো ভগ্নপ্রায়।
যে খেলায় তুই মরণগামী, আমারও তাতে মৃত্যু হয়।”
প্রতিপক্ষকেও ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।
আদর করতে ইচ্ছে করে। কাছে টানতে মন চায়।
প্রতিপক্ষের দুটো করতল ছু্ঁয়ে দিয়ে, মুঠো করে ধরতে চাই তার হাতের দুটো পাতা।
তাকে বলতে ইচ্ছে করে,
“তোর চোখের নিচের বিষণ্ন দাগ
আমার গালেও নেমে যায়।
তোর গলার ভাঁজের ঘামগুলো সব
আমার খাঁজেও জমে যায়।
তোর বুকের বাতাস উথালপাথাল
আমার বুকেও ঝড় তোলে।
তোর না বলা রোখ জেদ চেপে যায়,
আমার মনের কল্লোলে।”
প্রতিপক্ষকে আপন মনে হয় খুব।
খুব আপন। সবচেয়ে আপন।
সেই তো জানে সবচে ভালো,
কোন লড়াইয়ে মেতেছি দুজন।
দুজনেরই রাতের ঘুমের দুঃস্বপ্ন,
একই শঙ্কায় চোখ বোজে।
দুজনেরই ভয়ের দোলায়,
প্রতিটা ক্ষণের দিনরোজে।
প্রতিপক্ষকেও তাই বন্ধু মনে হয়। সুহৃদ মনে হয়।
মনে হয় বুঝি সে জানে,
তার আর আমার বুকের ক্ষত, কোন ওষুধের খোঁজ করে।
একই পথ্য, ভিন্ন তথ্য, এ বেলা-ও বেলা মন ভরে।
ইচ্ছে করে ডেকে বলি,
“তুই আর আমি শত্রু তো নই।
হস্তরেখায় তোর আর আমার
তেমন কোনো দ্বন্দ্ব নেই।
তবু কেন?
এত এত কাড়াকাড়ি
শত শত বাড়াবাড়ি
দেখতে কি পাস?
তোর আর আমার
কপালদুটোয় মিলটা কই?”
মাঝে মাঝে ভীষণ ইচ্ছে করে, প্রতিপক্ষকে ডেকে বলি,
“আয় না রে ভাই, পাটি বিছাই। একসাথে বসে থাকি।
গল্প শুনি তোরও দিনের, আমারও কিছু কথা বলি।
তোর যা ছিল, আমার সে কই?
আমি যা পাই, তুই তাতে নাই।
তোর আর আমার দুঃখ বড়, কষ্টগুলো ভিনরঙের
তোর মুখের বলিরেখা, আমার হাসি রংঢঙের।
আচ্ছা তো বল, কাঁদিস কেন? আমার বুঝি কান্না নেই?
হাঁপিয়ে উঠি দুজনেই তো, ভালোবাসি ভ্রান্তিকেই।”
প্রতিপক্ষ গুমরে ওঠে, ক্ষোভে, ঘৃণা, যন্ত্রণায়
নুয়ে পড়া শরীর জাগে প্রতিশোধের মন্ত্রণায়।
তারপরও তো বুঝতে পারি, তার অনুভূতির তীব্রতা।
আমার মনে যে পিপাসা, তারও তো সেই ক্ষিপ্রতা।
প্রতিপক্ষকে মানতে পারি, ভাবতে পারি।
জানতে পারি দহন তার।
খবর তো পাই,
জয় কোথায় আর কোথায় থাকে বৃহৎ হার।
মাঝে মাঝেই ভাবি বসে, প্রতিপক্ষের কাছে যাই।
করজোড়ে বলি কানে, “তুই যা চাস, আমিও তা চাই।
তবুও তোর দীর্ঘশ্বাস, আমার চোখে জল আনে
তোর গৌরব ভীষণ জানি, আমার কাছে হার মানে।
তোর ভেঙে পড়া মন, শান্তি খোঁজে,
জীবনের কাছে ভিক্ষা চায়।
আমি বুঝি তোর পৃথিবীতে, কত ঝড় আর কত প্রলয়!
তোর ঘরে আগুন, আমারও ঘর পোড়ে,
তোর ছাই সাজিয়ে ঘুরি, আমার সিঁথিজুড়ে।
আর কত মিথ্যে হাসবি, করবি কত সুখের ভান?
সব দেনা কি পাওনা হয়, সব দানের প্রতিদান?
তবু জানি তোর ক্লান্ত লাগে,
দহন জাগে,
ফেটে পড়িস খুব রাগে,
পক্ষে না হোক,
তোর প্রতি তাও মায়া যে আমার খুব জাগে।
হ্যাঁরে,
তোর মন খারাপ? তুই কেমন আছিস?
তোর কি খুব ক্লান্ত লাগে?”
বোকা ভালোবাসা
কতক অপেক্ষার প্রহর শেষে
অনন্ত প্রহর কাছে এসে মেশে।
আদরের চাদরে ঢেকে দেয় দেহ
প্রেম, কাম, ভালোবাসা
বাঁধভাঙা স্নেহ।
ছিঁড়েখুঁড়ে খায়, গভীরেতে ধায়
মুঠোভরা আবদার ফেলে দেওয়া দায়।
ভাঁজে ভাঁজে, খাঁজে খাঁজে,
শীৎকার মাঝে মাঝে
শরীরের চোরাগলি
আলোছায়া গেহ।
সকল সুধার তোড়ে,
কখনো শরীরজুড়ে,
কখনো জুড়ায় তৃষা দাঁতের শাসন
কখনো নেশার ঘোরে
মাতাল হৃদয় পোড়ে
নকশা আঁকে ত্বকে নখের নাচন।
ভিজে ভিজে মাখামাখি
গোঙানিতে ডাকাডাকি
জড়িয়ে আসা কণ্ঠ ভিজে ওঠে কামে
রক্তের নেশা ছোটে
দানবের ক্ষুধা জোটে
এই ঐশ্বর্য হায় কিনি কোন দামে?
তারপর ভেঙেচুরে, তৃপ্তির মোহসুরে
ঘুরে ঘুরে, ফিরে ফিরে
বারবার পিপাসায়,
যত চায়, তত পায়,
চেটেপুটে লুটে খায়
পড়ে থাকে আত্মার বোবা চেতনায়!
বোকা পাহাড় জানে সব
রক্ত-মাংসে বাড়ে শব
আঁচড়ের দাগে বাঁচে পরবর্তী আশা
যোনীতে-খনিতে, চিৎকারধ্বনিতে
মরে যায় প্রতি রাতে
বোকা ভালোবাসা।