সাইক্রিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোকের মুখ ভর্তি খোঁচা খোঁচা কাঁচা পাকা দাড়ি। দেখে মনে হচ্ছে রোজ সকালে নিয়ম করে ক্লিন সেভ করেন তবে কোনো বিচিত্র কারণে গত দু দিন সেভ করতে পারেন নি। তনু বসে আছে ভদ্রলোকের মুখোমুখি চেয়ারে। ডাক্তার ভদ্রলোকের চেহারা হাসি হাসি। তনুর ধারণা ছিল ডক্তারের চেহারা হবে আইনস্টাইন টাইপ। মুখভর্তি এলোমেলো দাড়ি আর মাথাভরা ঝাকড়া আউলাঝাউলা চুল। চেহারা থেকে জ্ঞানের স্পষ্ট আভা বের হবে। কিন্তু না, ডাক্তার ভদ্রলোককে দেখাচ্ছে একদম সাধাসিধে মানুষের মতোই। চোখে ভারী গ্লাসের চশমার কারণে তাকে দেখাচ্ছে কোনো কলেজের প্রিন্সিপাল কিংবা হাই স্কুলের হেড মাস্টারের মতো। বহু কষ্টে এই লোকের সানিধ্য পাওয়া গেছে। গত তিন দিন ধরে ক্রমাগত কম্পাউন্ডারকে ফোন করে করে অবশেষে আজ সিরিয়াল পাওয়া গেল। চার নম্বরে পরেছে তাঁর সিরিয়াল। প্রথম এবং দ্বিতীয়জন লাইন খালি করেছে। তৃতীয়জন আসেনি তাই সৌভাগ্যক্রমে এখন তনু ডাক্তারের সামনে বসে আছে। তার পরে আরো দুজনের সিরিয়াল আছে। তনুর কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে, কিন্তু অস্বস্তির কারণটা সে ঠিক আন্দাজ করতে পারছে না। ভদ্রলোকের চেহারা কিংবা পোষাকে কোথাও ডাক্তার ভাব নেই এটা অস্বস্তির কারণ হতে পারেনা। বরং তার আরো খুশি হওয়ার কথা। গল্প উপন্যাস কিংবা নাটকের মতো ধবধবে সাদা দাড়িওয়ালা কোনো ডক্তার তাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন নি, পুলিশি জবানবন্দির মতো করে। এটাই সবচেয়ে আশার বিষয়। ডাক্তার চোখ থেকে চশমাটা নামিয়ে রাখলেন। এতে তার চেহারা আরো সাধারণ হয়ে গেল। এতক্ষণ যাকে প্রিন্সিপালের মতো লাগছিল এখন তাকে লাগছে সমবয়সী কোনো বন্ধুর বাবার মতো। ভদ্রলোক ক্ষীণ তবে স্পষ্ট স্বরে বললেন,
: আপনার সমস্যা বলুন
: মানসিক সমস্যা!
: সাইকোলজির একজন চিকিৎসকের কাছে আপনি নিশ্চই পেট ব্যাথা, মাথা ব্যাথা কিংবা জ্বর জাতীয় সমস্যা নিয়ে আসবেন না, মানসিক সমস্যা নিয়েই আসবেন। কিন্তু সমস্যাটা কী বলতে হবে।
: আমার সমস্যাই হচ্ছে মানসিক সমস্যা। সেই সমস্যার প্রকাশ্য রূপ হচ্ছে আমার মাথায় উদ্ভট চিন্তা ভাবনা ঘুরে।
এবার ভদ্রলোকের মুখের হাসির আভা আরো প্রখর হলো।
: আপনার বয়স খুব কম মনে হচ্ছে।
: জি আমার বয়স সতেরো বছর সাত মাস।
ডাক্তার ভদ্রলোক সামান্য হকচকিয়ে গেলেন।
: এই বয়সে তোমার মানসিক সমস্যা?
: অনেকে তাই বলে।
: কিছু মনে করো না, তোমার বয়সী আমার একটা নাতনী আছে এবং তোমার চেহারাও তার সাথে খানিকটা মিলে যায় তাই তোমাকে তুমি করে বলছি।
: সমস্যা নেই।
: তুমি কী সেই যে গত কয়েকদিন যাবৎ এপোয়েন্টমেন্ট নেওয়ার চেষ্টা করছে?
: জি।
: তোমার মনে হয় যে তোমার মানসিক সমস্যা আছে?
: জি না আমার মনে হয় না। আমি এখানে নিজের ইচ্ছায় আসি নি, একজনের অনুনয়ে এসেছি।
: তোমার নাম কী?
: আমার নাম তনু।
: হিন্দু?
: জি না। এটা আমার ডাকনাম।
: আসল নাম কী?
: আসল নামটা আমি বলতে চাচ্ছি না। আমার আসল নামটা আমার পছন্দ না। বাবা ছাড়া আসল নামে আমায় কেউ ডাকেও না। ডাকনামেই সবাই ডাকে।
: তোমার মা কী নামে ডাকেন?
: আমার মা আমার জন্মের সময় ই মারা গেছেন। তাই তিনি ডাকার আর সুযোগ ও পাননি।
: সরি! আমরা এখন তোমার সমস্যায় সরাসরি চলে যাই। তোমার ভাষ্যমতে তোমার সমস্যা হচ্ছে উদ্ভট চিন্তা করা।
তনুর মনে হয়েছিল বিষয়টা ভদ্রলোক ভুলে গেছেন।
: জি আমি এই সমস্যাতেই আছি।
: আমার মনে হয় তোমার এই বয়সে উদ্ভট চিন্তা ভাবনা করাটা স্বাভাবিক পর্যায়ে পরে।
: আমারো তাই মনে হয় কিন্তু আমার পরিচিত মহলে সবাই মনে করছে আমার বিষয়গুলো যথেষ্টই অস্বাভাবিক।
: একটা উদাহরণ দাও তো।
: সপ্তাহ দুয়েক আগের কথা। হঠাৎ মাথায় এলো নতুন নতুন প্রজাতির ধান, ফল, ফুল সবই তো আবিষ্কার হচ্ছে। নতুন প্রজাতির পাখি আবিষ্কার করতে পারলে কেমন হয়? তারপর শুরু হলো পাখি বিষয়ক পড়াশোনা। তেমন কোনো তথ্যই রপ্ত করতে পারলাম না। আমার উদ্যেশ্য ছিল ভিন্ন দুই প্রজাতির পাখির জিন এক করে অন্য আরেক প্রজাতির পাখি আবিষ্কার করা। আশে পাশের অনেকের কাছ থেকে জানতে পারলাম, অন্য কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণী যেমন কুকুর, গরু, ছাগল, মহিষ ইত্যাদির স্পাম এক বিশেষ উপায়ে সংগ্রহ করা যায় সরাসরি, কিন্তু পাখির বেলায় তা করা যায় না। তারপরেও আমি আশাহত হইনি। কাটাবন থেকে একটা ছোট টিয়া পাখির বাচ্চা আনানোর ব্যবস্থা করলাম। আর আমাদের বাড়ির পাশে মস্ত একটা জাম গাছে কাকের বাসা ছিল। আমার দরকার ছিল একটা কাকের বাচ্চা। একদল শিশু যোগার করে ১০০ টাকা বখশিশের কথা বলে একটা কাকের বাচ্চা যোগার করে দেওয়ার অফার করলাম। কথামতো এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি শিশুর দলের পাঁচ জন কাঠের খাঁচায় একটা কাকের বাচ্চা নিয়ে হাজির। বখশিশ দিয়ে ওদের বিদায় করলাম। কাকের বাচ্চাটা মাদী না মর্দা জানা ছিল না তবুও এক খাঁচায় কাক আর টিয়া দুটি পাখিকে রেখে দিলাম। এই প্রজাতির পাখির একটা নাম ও ভেবে ফেলেছিলাম। কাক আর টিয়া, ‘কাটিয়া’।
: তারপর কী হলো?
: একদিন পরিস্কার করতে গিয়ে ভুলবসত খাঁচা খুলে রেখে দিয়েছিলাম। সকালে উঠে দেখি উড়ে চলে গেছে দুজন ই।
: এরপরেও তোমার মনে হয় না তোমার মানসিক সমস্যা আছে?
: না, হয় না। এবং না হওয়ার যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত কারণ আছে।
ডাক্তার ভদ্রলোক চোখে চশমা পরলেন।
: চা খাও?
: জি
ভদ্রলোক ইন্টারকাম বাজিয়ে একজনকে ডাকলেন। রোগা পাতলা গড়নের কালো একজন লোক। ডাক্তার সাহেব দুই কাপ চায়ের কথা বললেন। সঙ্গে সঙ্গে লোকটি বিদ্যুৎ গতিতে গেল এবং ঝড়ের গতিতে দুই কাপ চা টেবিলে রেখে চলে গেল। আশ্চর্যের কথা হচ্ছে এক ফোটা চা ও ছলকে পিরিচে পরলো না!
: আমি কখনো আমার কোনো পেশেন্টকে স্পেশাল ছাড়া এতটা সময় দেই না। সর্বোচ্চ ১৮ মিনিট। কিন্তু তোমার সাথে কথা বলছি প্রায় আধ ঘন্টা হয়ে গেল।
: আপনি বললে আমি অন্য একদিন আসতে পারি
: না থাক! আমি তোমার কথায় যথেষ্ট ইন্ট্রেস্ট পাচ্ছি। আজ আর অন্য কোনো পেশেন্ট দেখবো না।
তনু চায়ের কাপে চুমুক দিল। এ পর্যন্ত যতগুলো জঘন্য খাবার সে খেয়েছে তাদের মধ্যে এই চা অন্যতম। চিনির কোনো অস্তিত্ব আছে বলে মনে হচ্ছে না। তার চেয়ে বড় কথা তনুর প্রচন্ড সিগারেটের পিপাসা পেয়েছে। কিন্তু একজন সনামধন্য চিকিৎসককে নিশ্চই বলা যায় না, ‘আপনার সাথে পেচাল পেরে পেরে এখন আমার ভয়াবহ সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছে। মানে এই মুহুর্তে একটা সিগারেট ধরাতে না পারলে আমি মিনি স্ট্রোক করে এখানেই পরে থাকবো। ‘
ডাক্তার সামান্য গলা খাঁকাড়ি দিয়ে চায়ের কাপ সাইড টেবিলে রেখে দিলেন।
: কার পরামর্শে তুমি এখানে এসেছো?
: পাখিগুলো উড়ে যাওয়ার পর ও আমি আশাহত হইনি। আমার এক বন্ধুর মামা পাখি বিষয়ক কোনো এক সংস্থার সাথে যুক্ত ছিলেন। তারপর বহু কষ্টে তার সাথে যোগাযোগ করলাম ভদ্রলোকের সাথে।
: তারপর?
: সব কিছু খুলে বলার পর ভদ্রলোক জানালেন, নতুন জাতের পাখি আবিষ্কার আমাদের সংস্থার কাজ নয়, আমাদের কাজ হলো বিলুপ্তপ্রায় পাখিগুলোর সংখ্যা বাড়ানো। কিন্তু ফোনে কথা বলার পরেও ভদ্রলোক আমার সাথে দেখা করতে চাইলেন। দেখা সাক্ষাৎ এর এক পর্যায়ে আমার কথা শুনে তিনি আমার মাথায় হাত রেখে বললেন ‘আমি বাবা হিসাবে তোমাকে একটা অনুরোধ করতে চাই। মনে করো আমি তোমার বাবা। তোমাকে একটা অনুরোধ করলে তুমি রাখবে না? ‘ তারপর তিনি শার্টের বুক পকেট থেকে কয়েকটা ভিজিটিং কার্ডের মধ্যে থেকে আপনার ভিজিটিং কার্ড টা বের করে দিয়ে বললেন, ‘ ইনি হচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। সপ্তাহে তিন দিন ঢাকা হাসপাতালের চেম্বারে বসেন। তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার সাথে দেখা করবে। ‘ আমি কার্ড টা নিয়ে মাথা সামান্য কাত করে হ্যাঁ জানালাম। তাতপরেও ভদ্রলোকের সন্দেহ হলো যে আমি না ও যেতে পারি। আসলেই ঠিক! আমি আসতাম না। তখন ভদ্রলোক আমাকে দিয়ে কথা দেওয়ালেন যে আমি যেন সত্যিই যাই। যেহেতু কথা দিয়ে ফেলেছি। না এসে পারা যায়নি। তাই একবার দেখা করেই গেলাম।
: ভদ্রলোকের নাম কী কোনোভাবে হাসনাত?
: জি উনার নাম হাসনাত।
: আমার খুব বন্ধু মানুষ। পাশ করে বের হওয়ার পর হাতে কোনো চাকরি নেই। চেম্বার দেওয়ার সামর্থ্য নেই। আমার পড়েছি এমন এক বিষয় নিয়ে যে বিষয়ের চিকিৎসকের মুল্য তখনকার মানুষ খুব কমই দিতে জানতো। কোনোমতে চারটা টিউশনি পড়িয়ে মেসের ভাড়াটা দেই। তখন যে কী পরিমাণ অর্থ সহায়তা এই হাসনাত আমাকে করেছে তা ব্যাখ্যা করা দায়! রাস্তায় কোথাও দেখা হলে জড়িয়ে ধরে বলেছি পকেটে যা আছে বের করে দিয়ে দে আমার কাছে ভাত খাওয়ার টাকা নেই।
তনু সামান্য হাসলো।
: তোমার কী আর কোনো সিমটমস আছে? বলো দেখি।
: আরেক বিষয়ে পর্যবেক্ষণ প্রায় ছয় মাস আগে আমি করেছি। তিনটা বেলীফুলের গাছ কিনে আনি। একই সাইজের তিনটা গাছ। পূর্ব দিক মুখ করা বারান্দা বলে গাছ তিনটা সুন্দর করে সেট করে দিলাম। এরপর শুরু করলাম আসল কাজ। প্রথম টবের গাছটায় রোজ দুধ দিতাম। দ্বিতীয় টবে রোজ এক ব্যাগ বি পজিটিভ রক্ত দিতাম। এই রক্ত যোগার করতে আমাকে সাহায্য করেছিল আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু নাঈম। তার ধারণা ছিল আমার যখন হুজুক উঠেছে তাহলে ইন্ট্রেস্টিং কিছু আমি করেই ছাড়বো। ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত যোগার শুরু হলো। আর বেশ কয়েকবছর আগে ব্যাবসা এবং পারিবারিক জটিলতার কারণে হওয়া ডিপ্রেশন কাটাতে আমার বাবা পরিমিত পরিমাণ মদ্যপানের লাইসেন্স পান। এদিক সেদিক থেকে দামি দামি ব্রান্ডের মদ এনে তিনি তার ঘরের আলমারিতে রাখতেন। এবার তৃতীয় টবে আমি দেওয়া শুরু করলাম দামী ব্রান্ডের এলকোহল। আমি গাছগুলোতে কোনো পানি দিতাম না।
: তারপর? এর ফলাফল কী হলো?
: দুধ দেওয়ার ফলে প্রথম গাছটা তিন চার দিনের মধ্যে কেমন যেন সাদা সাদা ফ্যাকাশে হয়ে গেছিল। আর রক্ত দেওয়া গাছটায় পিঁপড়ার সংক্রমণে মারা যায়। তবে মারা যাওয়ার আগে গাছটার পাতাগুলোর আগা কেমন যেন নিলচে হয়ে গেছিল। তৃতীয় গাছটা কোনোমতে এক সপ্তাহ টিকে ছিল। কিন্তু শুঁকাতে শুঁকাতে শেষ পর্যন্ত তামাক পাতার মতো বর্ণ ধারণ করে।
ডাক্তার সাহেব আবারো চোখ থেকে চশমা খুললেন।
: মদের বিষয়ে তোমার বাবা তোমাকে কিছু বলে নি?
: আলমারি খুলে মদের বোতল চারটা খালি দেখতে পেয়ে বাবা প্রথম আমার কাছেই আসলেন। কারণ বাবার ঘর থেকে আলমারি খুলে মদ হাপুশ করার মতো দুঃসাহস বাড়িতে আর কারো নেই। তারপর আমি তাকে পুরো রিসার্চ পক্রিয়া বুঝিয়ে বললাম এবং টবগুলো দেখালাম। সব দেখার পর বাবাও অন্যদের মতোই মিনমিনিয়ে বললেন ‘তোমার মাথায় দোষ আছে। চিকিৎসা হওয়া দরকার, নয়তো কোনদিন নগ্ন হয়ে রাস্তায় বের হয়ে মানুষকে কামড়াবে।
ডাক্তার সাহেব চশমার বক্সে থাকা রুমালটা দিয়ে চশমার কাচটা মুছে চোখে পরলেন।
: এই সমস্ত ভয়ংকর রিসার্চের পরও তোমার মনে হয় না যে তোমার মাথায় সামান্য দোষ আছে, সময় থাকতে তার চিকিৎসা হওয়া দরকার?
: অবশ্যই না। কারণটা আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলছি। নিজের যায়গায় বসে কখনো অন্যের পরিস্থিতি কল্পনাও করা যায় না। উড়োজাহাজ আবিষ্কার করা ভদ্রলোকের নামটা এখন মনে পরছে না কিন্তু তিনি যখন আশে পাশের মানুষকে তার এই আবিষ্কারের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেন তখন তাকেও অনেকে উন্মাদ বলে বিদ্রুপ করতে থাকেন। আবার গাছ থেকে আপেল পরার মতো তুচ্ছ অতি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিউটন সাহেব কত বড় এক আবিষ্কার করে বসেন। আমাদের মতো মানুষের মাথায় আপেল পরলে আমরা তা হাতে নিতাম এবং বড় বড় কয়েক কামড়ে আপেলটা খেয়ে উচ্ছিষ্টগুলো দূরে ছুড়ে ফেলতাম। আবিস্কার তাতে হয়তো কয়েকশ বছর পিছিয়ে যেত। নিউটন সাহেবের আমলের কথাটা ভেবে দেখুনতো
গাছ থেকে আপেল নিচে পড়বে এবং নিউটন তা কামড়ে খাবে এটাই তখন স্বাভাবিক ছিল। সে যখন এই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাতামাতি শুরু করলো তখন নিশ্চই তার আশে পাশের লোকেরাও বলেছিল, ‘গাছ থেকে আপেল মাথায় পরেছে এ আর এমন কী মহাভারত ঘটনা? খেয়ে ফেল্লেই হতো। আর এই ছেলেই বা এই জিনিস নিয়ে এত নাচানাচি করছে কেনো? নিশ্চই মাথায় দোষ আছে।
ডাক্তার ভদ্রলোক এই কথার পৃষ্টে আর কিছু বললেন না।
: তোমার কী রাতে ঠিকঠাক ঘুম হয়?
: জি না আমি প্রায় রাতেই জেগে থাকি।
: নির্ঘুম থাকার কারণে অনেক সময় মস্তিস্কে নানান ধরণের জটিলটা সৃষ্টি হয়। আমি তোমাকে কিছু ঘুমের ঔষধ লিখে দেই তুমি সেগুলো নিয়ম করে খাও এবং এক মাস পর তুমি আবার আমার সাথে দেখা করো।
তিনি প্রেসক্রিপশনে ঔষধ লেখা শুরু করলেন। প্রেসক্রিপশন নিয়ে তনু বের হয়ে এলো। ডাক্তার সাহেব ‘নেক্সট ‘ বলে পরের জনকে ডাকলেন। চৈত্র মাসের রোদে আকাশ খাঁ খাঁ করছে। গল্প উপন্যাসের ভাষায় যাকে বলা হয় পীচ গলা গরম। তনুর মাথা সামান্য চিনচিন করছে। ঔষধগুলো কিনে নিয়ে দেখা যাক। ডাক্তার ভদ্রলোক কে বলা হয়নি যে রোজ নিয়ম করে দুটো দশ মিগ্রার ঘুমের ঔষধ খাওয়ার পর ও সে জেগেই থাকে। যার ফলে তার চোখের নিচে বিভৎস কালি পরে গেছে আর গালের হাঁড় শুকিয়ে বের হয়ে পরেছে। তনু বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আসিফ মেডিসিন কর্ণারে গিয়ে দাঁড়ালো। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের সামনের এই যায়গাটাতে ঔষধের দোকানের কোনো অভাব নেই। যেখানে যতদূর চোখ যায় শুধুই দেখা যায় বিভিন্ন মেডিসিন কর্ণার। উত্তপ্ত দুপুরে এই দোকানগুলো খালি থাকা স্বাভাবিক। তনু যে দোকানটার সামনে দাঁড়িয়েছে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কারণে সেখানে একটা মাছিও নেই। রোদে চোখ কটকট করছে। সানগ্লাস টা পরে বের হলে ভালো হতো। তনু প্রেসক্রিপশনটা ফার্মেসী তে থাকা অল্প বয়স্ক ছেলেটার দিকে বাড়িয়ে দিল। ছেলেটা এক নজর কাগজটায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে তা পেপার ওয়েটে চাপা দিয়ে ঔষধ খুঁজতে ব্যাস্ত হলো। পাশের দোকান থেকে ঔষধ কিনে বোধ হয় তনুর চাচাতো ভাইয়ের শালীটা বের হচ্ছে। এখানেই কোথাও থাকে ওরা। তনু বেশ কয়েকবার গিয়েওছিল ওদের বাড়ি। যায়গাটার নাম ঠিক মনে পরছে না। কে.পি.ঘোষ স্ট্রিট লেন? নাকি বাবুবাজার? খুব সম্ভবত যায়গাটার নাম বটতলা হতে পারে। যেখানেই হোক সেটা নিয়ে এখন চিন্তা করা যাবে না। তনু প্রাণপণে চাইছে এই মেয়েটা যেন তাকে না দেখে। যদি ভুলেও দেখে ফেলে তাহলে নির্ঘাত আগামী কালকের একাত্তর টিভির নিউজে গিয়ে সে এই খবর প্রচার করার চেষ্টা করবে। দুই বছর পরেও যদি তনুর কোনো আত্মীয়র সাথে এই মেয়ের দেখা হয় তাহলে যথাসম্ভব চোখমুখ করুণ করে বলবে ‘তনুকে তো সেদিন ঔষধ কিনতে দেখলাম। তনু যতটা সম্ভব ঘাড় ঘুরিয়ে রাখলো। তবুও শেষ রক্ষা হলোনা। পেছন থেকে আচমকা বলে উঠলো
: তনু না?
অগোত্যা! তনু ফিরে চেয়ে স্লান হাসি দিল।
: তুমি ঔষধের দোকানে কী করছো?
: ঔষধের দোকান ঘুরে দেখতে এলাম।
: ধ্যাৎ! তুমি সব সময় মজা করো। ঔষধের দোকান আবার দেখার কী?
: ও হ্যাঁ তাও তো কথা! ঔষধের দোকান আবার দেখার কী? তাও দোকানের পরিবেশ টা সুন্দর।
এতক্ষণে ছেলেটা ঔষধ প্যাকেটে ভরে স্ট্যাপলার করে ক্যালকুলেটরে হিসাব ও করে ফেলেছে। সব মিলিয়ে চারশ সত্তর টাকার ঔষধ। তনু ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিল।
মিতু জিজ্ঞেস করলো
: কিসের ঔষধ?
: আমাশয়ের।
দোকানের ছেলেটা মুচকি মুচকি হাসছে। তনু তাকে হকচকিয়ে দিয়ে বল্লো
: ভাই কিছু মনে করবেন না। আপনার নাম কী আসিফ?
ছেলেটা হ্যাঁ সুচক মাথা নাড়িয়ে বল্লো
: জি
তনু হাটা শুরু করলো। তনুর পিছু পিছু মিতুও আসছে। তনুর বিরক্তির সীমা রইল না।
: তোমাকে এরকম দেখাচ্ছে কেনো তনু?
: কী রকম?
: আগের চেয়ে কত শুঁকিয়ে গেছ। গালের হাঁড় দেখা যাচ্ছে।
তনু বিষয়বস্তু ঘোরাতে জিজ্ঞেস করলো,
: বাড়িতে ওরা কোথায় তুমি ঔষধ কিনছো?
: ভাবীর সিরিয়াস জ্বর। ভাইয়া তো ঢাকায় নেই তাই আমিই এসেছি। তুমি কেনো এসেছো?
: আমাদের বাসায় ও কেউ নেই। সবাই গেছে মুন্সীগঞ্জ আমার বড় ফুপুর বাসায়। ফুপুর এই যায় তো সেই যায় অবস্থা! আমি আর কাজের মেয়েটা বাড়িতে আছি। তোমাদের বাসা তো এখানেই কোথাও তাই না?
: এইতো আর চারটা বিল্ডিং পরই।
: তাহলে চলে যাও। অসুস্থ মানুষ রেখে এসেছ তাই তোমাকে আর আমাদের বাড়ি নিয়ে গেলাম না।
: তুমি এখন আর আমাদের বাড়িতে আসো না কেনো তনু? তুমি কত হাসির কথা বলো। তোমার কথা উঠলে আমরা সবাই হেসেই ফেলি।
তনু আবারো হাসলো।
চলে যাওয়ার সময় মিতু আবার জিজ্ঞেস করলো
: তোমার কী হয়েছে তনু?
তনু এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল―
: আমার আবার কী হবে? কিছুই হয়নি। কী হতে যাবে আবার?
মিতু চলে যাওয়ার পর তাত প্রতি বিরক্তি ভাবটা অনেকটা কেটে গেল। বরং মেয়েটার জন্য মায়া হলো। বেশী কথা বলা মানুষগুলোর মাঝে কোনো প্যাঁচ থাকে না। এই মেয়েটার বেশী কথা বলার স্বভাবই তাকে অনেকটা সহজ সরল করে দিয়েছে। আজকাল মানুষ হয়ে গেছে মেশিনের মতো। প্রয়োজন ছাড়া তাদের দিয়ে কথা বলানো যায় না। তনু একটা রিক্সা ডেকে উঠে পরলো।
: কই যাইবেন?
: আপনি ঘন্টাখানেক আমাকে নিয়ে এখানে সেখানে ঘুরবেন। চাইলে নদীর পারে জিঞ্জিরা ঘাটের দিকেও চলে যেতে পারেন। তারপর আমাকে বংশাল নামিয়ে দিয়ে চলে যাবেন।
তনু রিক্সার হুড তুল্লো না। রিক্সা চলছে। মাঝে মাঝে টুং টাং শব্দ হচ্ছে। আর চারদিকের মিশ্রিত কোলাহল। তনুর মাথা ঝিমঝিমের মাত্রা আরো বেড়ে গেল। এখন মনে হচ্ছে কয়েক হাজার মানুষ একসাথে তাকে বার বার জিজ্ঞেস করছে,
: ‘তোমার কী হয়েছে?’
অসাধারণ হয়েছে 🖤
আমি এমন অনেক উপন্যাস পড়তে চাই।।
৭ টা পড়েছি।।
Best of luck
Future te aro Valo Koro lekha lekhi te
Dua roilo……