হিমালয় থেকে যে জলধারা একবার বঙ্গোপসাগরের নেমে আসার সময় বুকে করে পলি নিয়ে এসে একটি ব-দ্বীপের সৃষ্টি করেছিল যেখানে একটি নতুন পতাকা উড়েছিল সেখানে একটি ঘরকে স্বর্গ করবার জন্য মেহরাব রহমান ঈশ্বরের করণিক হয়ে লিখবার কাজ শুরু করেছিলেন (তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ঘরকে করবো স্বর্গ’)। আজ তার অনেক বছর চলে গেছে। ইতোমধ্যে কানাডায় স্থিত মেহরাব রহমানের Poetry anthology ‘Butterfly Thunder’ এবং ক্যানাডা র Tellwell talwnt প্রকাশনী থেকে ইংরেজিতে SLAVE নামে আর একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে। এ বছরের একুশে মেলায় প্রকাশিত হয়েছে ‘আহা পাখি’ তার নবম কাব্যগ্রন্থ যা মিলিয়ে তার প্রায় ১৯টি বই প্রকাশ পেয়েছে। বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে জীবনানন্দ, সিকদার আমিনুল হকের পর শুদ্ধকবির কপাট মেহরাব রহমানই খুলে রেখেছেন ইংরেজি সাহিত্যে যেমন মিল্টন বা, Edmund Spenser শুদ্ধ কবি হিসেবে আমাদের কাছে পরিচিত। হিন্দি ভাষায় বাল্মিকীকে শুদ্ধতম কবি চিহ্নিত করা হয়ে থাকে, জাপানীদের ভেতরও শুদ্ধতম কবির জন্ম আছে, তবে এ প্রসঙ্গে ভিন্নস্থানে ভিন্নপাঠ। মূলত কবিদের মধ্যে যাঁরা যুদ্ধকে পরিহার করে সুন্দর ও সত্যের তারকারাজির সম্মিলন ঘটান বস্তুতান্ত্রিক বর্জ্য উপেক্ষা করে, তাঁদেরই শুদ্ধ কবির আখ্যা দেয়া হয়, এমনটি, শুদ্ধতম কবি সিকদার আমিনুল হক ভাইও আমাকে তাঁর কবিতা সম্পর্কে তাঁর নিউ এলিফেন্ট (রকেট মসজিদের পেছনে) রোডের বাসায় বলেছিলেন।
দীর্ঘদিন ধরে মেহরাব রহমান কবিতা লিখে যাচ্ছেন তার নিজস্ব পরিমণ্ডলে, কিন্তু কী সমৃদ্ধি বা পরিবৃদ্ধি এলো তার কবিতায় এতোদিনে! জীবনকে তিনি আগাগোড়া নশ্বর এই বিশ্বে সমুদ্রের দূর বাতিঘরের চিহ্ন দেখে আগাগোড়া টেনে নিয়েছেন। সেই কাঁটাতারের বেড়া, ধর্মান্ধতার ইতর জাতীয়তাবোধ, দ্রুতগামী ইঞ্জিনের ঝিক্ ঝিক্ গতির বিমূর্ত ভৈরবী কিংবা দরবারি কানাড়া ঢঙে গান গাওয়ার ধুলোবালি মাখা জীবনই তার কাছে পরম উপাসনা। কিন্তু গত শতকের তারুণ্য নিয়ে সেই ঘরকে করবো স্বর্গ-এর প্রেরণা নিয়ে আসা এক ঈশ্বরের করণিক অর্ধ-শতাব্দী পেরিয়ে তার কাব্যযাত্রায় নতুন কোন তান্ডব বা তুফানের মন্দিরা বাজাতে সক্ষম হলেন, এ প্রশ্ন কবি মেহরাব রহমানের সচেতন পাঠক করতেই পারেন। কারণ একজন কবির সচেতন পাঠকই কবিকে তার আলোকিত শহরের দিকে যেতে উদ্বেলিত করতে পারেন।
মেহরাব রহমান বরাবর তার কবিতায় ধুসর পৃথিবীর বাষ্পীয় ইঞ্জিনের কয়লা পোড়ার ছাই, চিরচেনা স্টেশন, ভোকাট্টা ঘুড়ি, দূরের জাহাজের ভেঁপু, আগ্নেয়গিরির লাভা, প্রাণের স্বদেশ রাতের মোহনায় নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। এবারের কাব্যগ্রন্থের নাম তিনি এতোদিনের চর্বিত নামের বাইরে এসে ‘আহা পাখি’ নামকরণ করেছেন। আর এই পাখিকে তিনি এবার দেখলেন তার ঘরে ফেরার নেই কোন তাগিদ। এবারের কবিতায় এসেছে “গুলি খেয়ে খেয়েও আবু সাইদ স্থবির অনড় দাঁড়িয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল/ এতটুকু নতজানু হয়নি সে/ মেরুদণ্ড বিষুব রেখার মতো/ সোজা ছিল” (পৃ-৭৭)। শুদ্ধ কবিদের জগৎ থেকে এবার বোধহয় মেহরাব রহমানকে সামান্য সরে আসতে দেখা যায়। দেখা যায়, শুদ্ধ কবিরা স্থানীয় রাজনীতিতে নিজদের জড়িয়ে ফেলেন না। তাদের কবিতায় তারা সবসময় প্রকৃতি, দেশজ-লোকজ-ঐতিহ্যগত বলয়ে ব্যোমযান চালান। এটি কখনো লোকজ বীরত্বগাথা দৃশ্য হয়ে আসতে পারে। শুদ্ধকবি মেহরাব রহমান বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবকে এ দেশের দেশজ ইতিহাস হিসেবে মনে করে নিয়ে সামাজিক ইতিহাসকে শুদ্ধতার বিশ্লেষণে গ্রহণ করেছেন কী না তা ভবিষ্যৎ বলবে।
৩৩টি কবিতা নিয়ে এবারের ৮৫ পৃষ্ঠার মুদ্রিত সংযোজনে কবিতা কন্যা ও অণুর ভিতর পরমাণু নামে দুটি কবিতাগুচ্ছও রয়েছে। শুরুতেই বলা হয়েছে শুদ্ধ কবিদের পতাকাতলে চর্চা করা কবি মেহরাব রহমান নিত্যদিনের বৈষয়িক চিন্তায় অনিচ্ছুক থেকে শাশ্বত এক “আমি অরণ্য, ঘন সবুজ অনুগামী/ শাখায় শাখায় কাঠবাদামের গন্ধ/ শুঁকে শুঁকে নির্মাণ করি ভালোবাসার অভূতপূর্ব ছন্দ” (পৃ-৩৬)-চর্চা করে যান। তবে তা “অলৌকিক বিমূর্ত আনন্দ/ মাত্রাহীন স্বরবৃত্ত ছন্দ/ আহা সেই দুরন্ত ওষ্ঠদ্বয়/ আবার যখন অশান্ত হয়/ পরতে পরতে কাঠকয়লার পোড়া আগুন/ ধোঁয়াটে গন্ধ হাতে নিয়ে দেহতে দোঁহাতে/ জলের মতো মিশে যাওয়া/ অবেলার বসন্ত হাওয়া/ যেন সমর্পিত সিজদা/ জায়নামাজে” (পৃ : ৫৩) তার সনাতন কাব্য অভ্যেস।
সম্প্রতি লন্ডন বা চিকাগো থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ইংরেজি কবিতাপত্রগুলোতে কবিতার কিছু ভিন্ন সজ্জা দেখা যাচ্ছে। ঠিক সেরকমই মেহরাব রহমানের কবিতাতেও এসেছে সেরকম সজ্জা- “আয়ুষ্কাল কত / তোমার জন্ম পরিধি / কখন কোথায় মৃত্যু / কে জানে / গণমাধ্যমে তোমার অসুস্থতা / কিংবা মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হয় কদাচিৎ /” … (পৃ-১৮)। এমনকি তার কবিতাতেও এসেছে ইংরেজি ছন্দোবদ্ধ চরণ, তবে এটি এর আগেও সাযযাদ কাদির-এর বাংলা কবিতায় দেখা গেছে।
মেহরাব রহমানের কবিতাগুচ্ছ এক ঝলকে দেখতে গেলে কবিতার বিশ্ব পরিচয়ে অবগাহন বা সন্তরণ জরুরি হয়ে পড়ে। বিশ্বে কবিতার বাগানে অনেক পরিবর্তন এলেও কলকাতা বা বাংলাদেশের কবিতায় কিছু বহুব্রীহির চমক ছাড়া চিত্রের বা বৈষয়িক তেমন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এখানে মেহরাব রহমান যেহেতু ইউরোপ ও আমেরিকার মধ্যগগণে বসে আছেন, সেজন্য কালেভদ্রে হলেও বিশ্বমানচিত্রের কাব্যধারা নিয়ত পঠনের সুযোগ পাচ্ছেন। এ কারণেই তার কবিতায় শুদ্ধতম মনন থেকে যায়, “কবির মাথা নষ্ট হয়েছে নিশ্চয়ই/ এই কথাগুলো বৃষ্টির সাথে যায় না/ দুঃখিত পাঠক সমাজ/ ক্ষমা চাই/ আমি কবিতার ক্যানভাসে ভুল করে/ অপ্রাসঙ্গিক কিছু ছাপচিত্র এঁকে ফেলেছি/ ডলার শপের সস্তা এক্রেলিক পেইন্টে/ কী করা/ আমাদের এক চিন্তার ঘরে/ ভিন্নচিন্তার ঘুনপোকার/ অনধিকার চর্চা” (পৃ-৪৯)। এভাবে কবি কবিতায় এক ধুসর মাটির ঘ্রাণ বয়ে নশ্বর জীবন নিয়ে অবিনশ্বর ব্যোমকেশে আলবাট্রসের মতো ঝড়ের দিকে ছুটে চলেছেন।
আহা পাখি, মেহরাব রহমান, প্রকাশকাল-বইমেলা, ২০২৫, প্রচ্ছদ- সোহেল আশরাফ, প্রকাশক-স্বদেশ শৈলী, বাংলামোটর, ঢাকা, মূল্য ৩২৫ টাকা।