জীবন দর্শন ও সাহিত্য-বৈশিষ্ট্য
১৯৭৮ সালে ময়মনসিংহ জেলা বোর্ড প্রকাশিত ‘ময়মনসিংহের সাহিত্য ও সংস্কৃতি’ সংকলনে রওশন ইজদানীর ‘আমি কাদের কবি’ নামে একটি কবিতার উদ্ধৃতি পাওয়া যায়। কবি আশুতোষ পাল সংকলনে তাঁর প্রবন্ধে তাহেরউদ্দীন মল্লিক সম্পাদিত ‘ভোরের সানাই’ পত্রিকা থেকে এই উদ্ধৃতি দেন। কবিতাটিতে রওশন ইজদানী’র জীবন দর্শনের ইঙ্গিত মেলে।
‘নীচের তলায় আমি থাকি নীচের তলার কবি,
নীচের তলায় বইসে আঁকি নীচের তলার ছবি।
নীচের তলায় বহুত মানুষ থাকে
উপর তলার কেউনা খবর রাখে …
এরাই আমার জ্ঞাতির চেয়ে জ্ঞাতি
পড়শী আমার-আমার আপন জাতি
এদের মুখে ফুটলে হাসি, আমিও হাসি তাই,
এদের মুখে লাগলে কালি, আমারও হয় ছাই।’
এ কবিতায় দেখা যায় রওশন ইজদানী যেমন লোকায়ত জীবন ধারায় বিশ্বাসী, তেমনই তাদের প্রতি একটা অঙ্গীকারও আছে তাঁর। শুধু নিজে একা একা বাঁচা নয়, শহুরে জীবনের স্বাতন্ত্র্য বিলাসী হয়ে নয়, সাধারণ গণমানুষের সাথে যুক্ত হয়ে বাঁচা, তাঁদের জীবনের সাথে জীবন যোগ করাই ছিল তাঁর আদর্শ। ইচ্ছা করলে তিনি শহরবাসী হতে পারতেন, সে সুযোগও তাঁর এসেছিলো। কিন্তু তিনি গ্রামে ফিরে যান। রোগব্যাধিতে অসুস্থ-কিন্তু প্রত্যয়ী, সারল্য মÐিত অনাড়ম্বর ধর্মাশ্রয়ী এবং সংগ্রামী এক জীবন। তাঁর মৃত্যুর পর ২৩ জুন ১৯৬৭ দৈনিক ‘আজাদ’-এর সম্পাদকীয়তে লেখা হয়ঃ
‘… পল্লী ঐতিহ্যের তিনি ছিলেন প্রতীক। তাই শেষ পর্যন্ত সব ছাড়িয়া পল্লীতে তিনি ফিরিয়া যান। তিনি যে লৌকিক ধারার কবি, এভাবে সে লৌকিক ধারাতে তিনি নিজেকে একাত্ম করিয়া মিশাইয়া দিয়াছেন।’
কবি নিজেও বলেছেন, ‘‘আমি এক অনাখ্যাত, অনাদৃত ‘পল্লী দুলাল’। পল্লীর প্রতিটি হাসিখুশিতে, প্রতিটি শোকে দুঃখে, প্রতিটি আরামে আরাশে আমি মিশে গেছি এই পল্লীর সাথে-ভালোবেসেছি এর প্রতিটি ধূলিকণাকে, সহজ করে একান্ত আপন করে বুকে পেয়েছি এই মাটির গভীরে পল্লীকে। তাই এ পল্লীগীতির সঙ্গে আমার পরিচয় নিবিড়- একান্ত অন্তরঙ্গ; এ পল্লী আমার, আমি এ পল্লীর।”
‘রঙিলা বন্ধু’র মুখবন্ধে ইজদানীর এ হৃাদিক উচ্চারণ ছিল পল্লী জীবনের প্রতি তাঁর আন্তরিক অঙ্গীকারেরই প্রকাশ। এ অঙ্গীকার যিনি করতে পারেন তাঁর পক্ষে সাহিত্যে পল্লীর প্রকাশ রীতিকেই অবলম্বন করা স্বাভাবিক। আর এ বিষয়ে সাহিত্যের আধুনিকতার এই যুগেও এতটুকু দ্বিধা ছিলো না তাঁর মধ্যে। এ প্রসঙ্গে তাঁর মৃত্যুর আগে আঠারবাড়িতে অনুষ্ঠিত সভায় প্রদত্ত ভাষণটি পুনরায় স্মরণ করা যেতে পারে। সেখানে তিনি সত্যিকার পল্লী সাহিত্যচর্চার জন্য আঞ্চলিকতাকেই আশ্রয় নেবাব কথা বলেছেন জোরে শোরে। তাঁর মতে পল্লীসাহিত্যের ভিত্তিই আঞ্চলিকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত না হলে সেটা হবে কৃত্রিম। এ প্রসঙ্গে তাঁর ‘আমি কাদের কবি’ থেকে কযেকটি চরণ উল্লেখ করা যেতে পারে।
‘পল্লী কবি অনেক জনাই উপর তলায় থাকে,
সখ করিয়া নীচকে দেখে চশমা দিয়া নাকে—
নীচের তলার অনেক কথা কয়
পরের মুখে ঝাল খেলে যা হয়
পালিশ করা দরদ দিয়ে পালিশ সুরে ডাকে
সবাই শুনে এমনি অবাক-অবাক চেয়ে থাকে।
আমার কথায় এতটুকুন পালিশ টালিশ নাই
যাদের লাগি সাজছি ‘গায়েন’ তাদের সুরেই গাই।’
মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেনঃ
‘জসীমউদ্দীন কাহিনী কাব্যের ঐতিহ্যকেই অনুসরণ করেছেন, রওশন ইজদানীর রচনাতেও এই একই ঐতিহ্যের অনুসরণ লক্ষ্য করা যায়। এঁরা খÐ কবিতায় গ্রামীণ পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। লোককাব্যের আঙ্গিকে রওশন ইজদানী ইসলামী জীবনাদর্শ এবং মুসলিম ঐতিহ্যমূলক কাহিনীও রূপায়িত করেছেন। লোকভাষায় গ্রামীণ প্রেমকাহিনীও রূপ পেয়েছে তাঁর অনেক রচনার । ভাষারীতির দিক থেকে জসীমউদ্দীন ও রওশন ইজদানীর মধ্যে যে স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্য করা যায় সেটি প্রধানতঃ যুগ চেতনার।
…. কলিকাতা কেন্দ্রিক আধুনিক সাহিত্যের ভাষাকে তিনি আমাদের ভাষা বলে স্বীকার করতেন না। তিনি বলতেন, শতকরা ৮০ জন মানুষ যে ভাষা বোঝে না, বলে না-সে ভাষা আমাদের ভাষা হতে পারে না। আমাদের সাহিত্যের ভাষার উৎস হবে জনজীবন, ঐতিহ্য হবে পুঁথিসাহিত্য, লোকসাহিত্য। তাঁর বিশ^াস ও ধ্যানধারণারই প্রতিফলন রয়েছে তার সাহিত্যকর্মে।’
মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ তাঁর স্মৃতিকথায় আরও লিখেনঃ
‘‘তিনি ছিলেন একজন সুদক্ষ প্রæফ রীডার-তাঁর প্রতিটি শব্দের বানান জ্ঞান ছিল নির্ভুল। তাঁর হাতের লেখা ছিল খুবই সুন্দর। আমি তাঁর এই দ্বিবিধ গুণের কাছে ব্যক্তিগতভাবে ঋণী। আমি যখন মওলানা শিবলী নোমানীর ‘আল ফারুক’ গ্রন্থটির বঙ্গানুবাদ করি, তিনি তার স্ক্রিপ্ট আগাগোড়া দেখে দিয়েছিলেন। ১৯৫৭ সালে আমার তর্জমাকৃত মওলানা আজাদ-এর ‘ইনসানিয়াৎ মওত কা দরওয়াজা পর’ গ্রন্থটির বাংলা নামকরণ তিনি করেন ‘জীবন সায়াহ্নে মানবতার রূপ’। অদ্বৈত মল্লবর্মনের ‘তিতাস একটি নাম’ বইটি রচনার ব্যাপারেও তিনি উদার সহযোগিতা দেন। দু’জনে এক মেসে পাশাপাশি সীটে থাকতেন।’’
কবিসঙ্গঃ
পেয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্য
বলা যায়, তাঁর আনুষ্ঠানিক সাহিত্য জীবনের সূচনা হয় বিভাগ-পূর্ব সময়ে কলকাতা থেকে। কলকাতায় তিনি কবি নজরুলের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন-নজরুল তাঁর কবিতা পড়ে উৎসাহ দিয়েছিলেন। এই সময় আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, ফজলুল হুক সেলবর্ষী, কবি বেনজীর আহমদ প্রমুখ সুধীজনের সাথে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আজাদের মুজিবর রহমান খাঁ ছিলেন ইজদানীর অন্যতম প্রধান সুহৃদ। গোলাম মোস্তফার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তাঁর। গোলাম মোস্তফার বাসায় রবিবারের সাহিত্য আড্ডা তাঁকে ছাড়া জমতো না। ঢাকায় পঞ্চাশ দশকের প্রথম দিকে কবি ফররুখ আহমদ, কবি আশরাফ সিদ্দিকী, কবি তালিম হোসেন, কবি আবদুর রশীদ খান, কবি আবদুর রশীদ ওয়াসেকপুরী আর কবি রওশন ইজদানী মিলে একটি সাহিত্যগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। এঁরা প্রায়শই নাজিম উদ্দীন রোডের ওপর তৎকালীন রেডিও অফিসের সামনে আবন মিয়ার রেস্তোরা এবং আজাদ অফিসের সম্মুখস্থ এক রেস্তোরার সাহিত্য অডিডা জমাতেন। ইজদানী হাস্য রসিক ছিলেন। যেমন কবি আবদুর রশীদ ওয়াসেকপুরীকে নিয়ে ছড়া কাটতেন : ‘অজাতের সভাকবি ডালপুরি খান বেনামে কাব্য লিখে আসর জমান’।
ব’নজীর আহমদের সাথেও তাঁর হৃদ্যতা ছিল। ঠাট্টা করে ব’নজীরকে তিনি ‘বনজীব’ সম্বোধন করতেন। লোক সাহিত্যের বিশিষ্ট সংগ্রাহক অধ্যাপক মনসুরউদ্দীনের সাথে সম্পর্ক ছিল গভীর। কবি গোলাম মোস্তফার বাসা থেকে ফেরার পথে তাঁর বাসায় একবার ঢু মেরে তামাক খেয়ে যেতে ভুলতেন না। এ প্রসঙ্গে তৎকালীন আলীয়া মাদ্রাসার অতিরিক্ত প্রধান মৌলভী ও মাদ্রাসা ছাত্রাবাসের সুপার আবদুর রহমান কাশগড়ীর সাথে তাঁর সম্পর্কের কথা অবশ্যই স্মরণ করতে হয়। মৌঃ কাশগড়ী ছিলেন সোভিয়েত মধ্য এশিয়ার লোক, এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন উর্দু কবি ও জবরদস্ত আলেম। তিনি একসময় লক্ষেœৗতে থাকতেন । শেরে বাংলা ফজলুল হক যখন অবিভক্ত বাংলার শিক্ষামন্ত্রী তখন তিনি মৌ: কাশগড়ীকে কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় নিযুক্ত করেছিলেন। মৌ: কাশগড়ী ও রওশন ইজদানীর মধ্যে গড়ে উঠেছিল সুনিবিড় সম্পর্ক। দু’জনেই ছিলেন কবি-কিন্তু কেউ কারুর ভাষা বুঝতেন না। অথচ দু’জনে মিলে ঘন্টার পর ঘন্টা নিবিড় সখ্যতায় পরস্পর ভাববিনিময় করতেন-এ ছিল এক বিস্ময়কর ব্যাপার। জীবনে বহু জ্ঞানীগুণী ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছিলেন রওশন ইজদানী। আরো যাঁদের বন্ধুত্ব অর্জন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে তৎকালীন আলীয়া মাদ্রাসার শিক্ষক মৌঃ মমতাজ উদ্দিন (রাজনীতিক-লেখক-আইনজীবী প্রয়াত মওদুদ আহমদের পিতা), কবি সুফিয়া কামাল, ঈশ্বরগঞ্জের ঝাটিয়া হাইস্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক আবু ফাতেমা মুহাম্মদ ইসহাক, বিশিষ্ট সাংবাদিক সানাউল্লাহ নুরী, কবি আহসান হাবীব এবং সাংবাদিক সিরাজউদ্দীন হোসেন ছিলেন অন্যতম। সিরাজউদ্দীন তাঁকে আদর করে ‘পেয়াজ রশুন’ বলে ডাকতেন। কবি হাবীবুর রহমানের সাথেও ঘনিষ্ঠতা ছিল।
যে বই তাঁকে সর্বাধিক খ্যাতি এনে দেয়
যে বইটি তাঁকে সর্বাধিক খ্যাতি এনে দেয়, সেই ‘খাতামুন নবী-ঈন’ তিনি ১৯৫৬ থেকে লিখতে শুরু করেন। কবি ফররুখ আহমদ এ ব্যাপারে তাঁকে অনুপ্রেরণা যোগান এবং রসুল (দঃ)-এর জীবন সংক্রান্ত তথ্যাদি দিয়ে সহযোগিতা করেন। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় বরিশালের গীর্জা মহল্লা থেকে। প্রকাশক ছিলেন মৌঃ মাহবুবুর রহমান খান (বাংলাবাজারস্থ রশিদ বুক হাউজের মালিক)। মৌঃ আবদুল হামিদ (চক বাজার এমদাদীয়া লাইব্রেরী মালিকের পুত্র), মৌঃ মাহবুবুর রহমান খান এবং ফররুখ আহমদ-এই তিন জনে মিলে বইটির প্রকাশনার খরচে আর্থিক সহায়তা করেন।
সাধারণ মানুষের ‘কবি সাব’
সাহিত্যচর্চা পাশপাশি তিনি অনেকগুলো স্কুল পাঠ্যপুস্তক লিখেছিলেন । তৎকালীন মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সেক্রেটারী বই লেখার জন্য প্রথম দিকে পারিশ্রমিক হিসেবে নগদ টাকা দিতেন। পরে ইজদানীর বিষয়বুদ্ধি বর্জিত স্বভাব ও টাকা খরচ করে ফেলার প্রবণতা দেখে নগদ টাকা না দিয়ে ইজদানীকে কলাবাগানে বাড়ি করার জন্য জমি কিনে দিয়েছিলেন। ইজদানী সেখানে গ্রামের ধরনে একটি কাঁচা বাড়ি নির্মাণ করে বসবাস শুরুও করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন দেখা গেল ইজদানী শহর জীবনের ইতি টেনে দিয়েছেন। কাউকে কিছু না বলে অত্যন্ত অল্প দামে বাড়িসহ সেই জমি বিক্রি করে দিয়ে তিনি গ্রামের বাড়ি চলে আসেন। প্রকৃতপক্ষে রওশন ইজদানী ছিলেন একজন আত্মহারা বাউল স্বভাবের খাঁটি পল্লীকবি। সুফীবাদের দিকেও তাঁর ঝোঁক ছিল। মতাদর্শের ক্ষেত্রে ইসলামী ভাবধারার অনুসারী ছিলেন। পাকিস্তান আন্দোলনকালে মুসলিম জাগরণীমূলক কিছও গানও লিখেছিলেন। ভাষা আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন তিনি। তমুদ্দুন মজলিশের সাথে যোগাযোগ ছিল তাঁর। জীবন ছিল বিলাসব্যসন মুক্ত। সাহিত্যের প্রতি ছিল গভীর টান। যেখানে যতো দূরেই সাহিত্য সভা হোক, তাতে যোগ দিতে আগ্রহের অভাব ছিল না। স্থানীয় স্কুলগুলি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁকে বিশেষ সন্মানের সাথে নিয়ে যেত। গ্রামের লোকেরা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে ‘কবি সাব’ বলে ডাকতেন। পরোপকার বৃত্তি ছিল তাঁর স্বভাবের একটি বিশেষ দিক। শেষ জীবনে তিনি আরও বেশি উদাসীন হয়ে পড়েছিলেন।
জীবনের শেষ বেলা
রওশন ইজদানীর জীবনকাল দীর্ঘ ছিলো না। পঞ্চাশ বছর বয়েসে তিনি প্রয়াত হন। সেই হিসেবে তাঁকে অকাল প্রয়াতই বলতে হয়। ‘আজাদ’ ছেড়ে আসার পর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হন। তখন তাঁর বয়স উনচল্লিশ বছর। ১৯৫৮ সালের ফেব্রæয়ারী মাসে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত বই ‘মোমেনশাহীর লোকসাহিত্য’-এর ভূমিকার তিনি লিখেছেন :
‘পল্লীকে জানতে হলে যেমন সাধনার দরকার, তেমন প্রয়োজন…এর অধিবাসীদের নিবিড় সান্নিধ্য ও সাহচর্য্য লাভ করা। আমি তাই এ পল্লীকে জানার জন্য, এর প্রতিটি আচার-অনুষ্ঠানের জন্য, এর সমাজ-মানসের খাঁটি রূপটি নিরীক্ষণের জন্য দীর্ঘ বার বছর ধরে এর আনাচে কানাচে বিচরণ করেছি-মাটির গাঁয়ের মাটির আসরে বহু বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছি-এদের কাছ থেকে পুস্তকের মালমসলা সংগ্রহ করেছি।’
লোকসাহিত্য সংগ্রহের জন্য এই অপরিসীম পরিশ্রম হয়তো তাঁর স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল-যার জন্যে তিনি টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। অর্থাভাবে তাঁর সুচিকিৎসার কোনো সুযোগ ছিলো না, যে কারণে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয় নি।
প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ এবং তাঁর মধ্যেকার পত্র বিনিময়ে জানা যায়, ‘ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশনস’-এ তিনি চাকুরি পেয়েছিলেন ১৯৫৮ সালের ১৮ই নভেম্বর। কিন্তু ভগ্ন স্বাস্থ্যের দরুন এ চাকুরিও তাঁর পক্ষে বেশিদিন করা সম্ভব হয়নি। সেই সময় তিনি ঢাকার বসবাস উঠয়ে চলে আসেন নিজ গ্রামের বাড়িতে।
১৯৬৬ সালের মে-জুন দিকে কবির অসুস্থতা আরো বেড়ে যায় এবং মুখে ঘা হয়। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ এপ্রিলের সৈয়দ আবদুস সুলতানের এক চিঠি থেকে জানা যায় রওশন ইজদানী এক ধরনের ক্যান্সারে ভুগছিলেন। ময়মনসিংহের সূর্যকান্ত (এসকে) হাসপাতালের ডাঃ মীর্জা (এফ.আর.সি.এস) তাঁকে পরীক্ষা করেন। ময়মনসিংহে চিকিৎসার সুযোগ না থাকায় তাঁকে ঢাকা গিয়ে মেডিক্যাল কলেজের ক্যান্সার ওয়ার্ডের ডাঃ করিম (ডি.এম.আর.টি)-এর অধীনে চিকিৎসা গ্রহণের পরামর্শ দেন। একই তারিখে লিখিত প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ’র এক চিঠিতে দেখা যায়, মীর্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালের ডা: সতীশচন্দ্র বণিকের উদ্দেশে তিনি লিখেছেন :
‘প্রিয় ডাক্তার বাবু, আদাব। কবি রওশন ইজদানী সত্যিকার কবি। ইনি কবিতার জন্য আদমজী পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু এঁর দারিদ্র্য কোন দিনই ঘুচে নাই। এক্ষণে অসুস্থ হয়ে দারিদ্র্যের নিম্নতম স্তরেরও নীচে নেমে গেছেন। আপনাদের হাসপাতালে যাচ্ছেন। যত প্রকার সাহায্য সঙ্গতভাবে সম্ভব তার জন্য তা করলে নিতান্ত বাধিত বোধ করবো। আপনার ইবরাহীম খাঁ।’
উল্লেখ্য, ইজদানীর এই অবস্থায় দেশবাসী একেবারে নিশ্চুপ থাকে নি। ‘আজাদ’-এ প্রকাশিত এই সময়ের একটি ছোট্ট খবর :
‘বাংলা একাডেমী কাউন্সিল সম্প্রতি ইহার এক বৈঠকে কবি রওশন ইজদানীকে এককালীন ৫০০.০০ টাকা সাহায্য দানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছে। অসুস্থ অবস্থায় কবি যাহাতে অবিলম্বে এই অর্থ সাহায্য লাভ করিতে পারেন, সেজন্য কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য শাহেদ আলীকে এই টাকা লইয়া যাওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হইয়াছে। কাউন্সিল এক প্রস্তাবে সরকারকেও এই দুঃস্থ কবিকে সাহায্য দানের আবেদন জানাইয়াছে এবং অবিলম্বে রুগ্ন কবিকে সাহায্যদানে অগ্রণী হইতে অনুরোধ করিয়াছে।’
কবির মৃত্যুর পর তৎকালীন ‘দৈনিক পাকিস্তান’-এর ২৩ জুন ১৯৬৭ তারিখের সম্পাদকীয় ছিল :
‘মৃত্যুর পূর্বে অসুস্থ কবি রওশন ইজদানীর চিকিৎসার ব্যাপারে সাহায্যের জন্য দেশের বহু ব্যক্তি ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান স্বেচ্ছায় সক্রিয় হইয়া উঠিয়াছিলেন। কবির প্রতি দেশবাসীর সহানুভূতি ও আন্তরিকতার পরিচয় তাতে পরিস্ফুট হইয়াছে সন্দেহ নাই। কবি অন্তিম মুহূর্তে দেখিয়া গিয়াছেন দেশবাসী তাঁর সাধনার মূল্য দিয়াছে, তাঁর পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। তিনি নিঃসঙ্গ ছিলেন নাÑএই সান্ত¡না হয়তো জীবনের শেষ মুহূর্তকে তৃপ্তির স্পর্শে মহিমান্বিত করিয়া তুলিতে পারিয়াছিল।’
এ মন্তব্য সঠিক ছিল। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির পর দেশের বহু সুধী ও শুভানুধ্যায়ী ইজদানীকে ক্যান্সার ওয়ার্ডে দেখতে যান। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রায় প্রত্যেক বিকেলেই যেতেন। ইজদানী তাঁর অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন। এ ছাড়া, প্রায়শই তাঁর রোগশয্যার পাশে উপস্থিত হতেন কবি ফররুখ আহমদ, প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ, কবি সুফিয়া কামাল, কবি বেনজীর আহমদ, কবি তালিম হোসেন, কবি মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ প্রমুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক অধ্যাপক নিয়মিত দেখাশোনা করতেন তাঁকে। এ ছাড়া, এ সময় সার্বক্ষণিক সেবা শুশ্রƒষা করেন তাঁর এক ভাগ্নে মনফর উদ্দীন। ইজদানী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান লেখক সংঘের সদস্য ছিলেন। তাঁকে এক পাউÐ রক্ত দিয়ে সাহায্য করেন লেখক সংঘের তৎকালীন অফিস সম্পাদক পরবর্তীতে ইসলামিক ফাউÐেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত ‘অগ্রপথিক’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক শাহাবুদ্দীন আহমদ। মোহাম্মদ মাহ্ফুজউল্লাহ তাঁর স্মৃতিচারণে বলেন :
‘ফররুখ আহমদ ও আমি এক বিকেলে মেডিক্যাল কলেজের ক্যান্সার ওয়ার্ডে রওশন ইজদানীকে দেখতে গেলাম। এর আগে কোন ক্যান্সার রোগীকে দেখিনি। তাই ধারণা ছিল না, এই রোগ কি ভয়াবহ আর যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে। শুনেছিলাম, রওশন ইজদানী জিহ্বার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। গিয়ে দেখলাম সত্যিই তাই। কিন্তু তার জিহ্বা আর মুখের অবস্থা দেখে বেশীক্ষণ তাকাতে পারলাম না। দেখলাম, জিহ্বা ফুলে মুখের অভ্যন্তর সম্পূর্ণ ভরে গেছে, সারা মুখমন্ডল হয়েছে বীভৎস। মুখ থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে রক্ত পড়ছে। তিনি কথা বলতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু কিছু অস্পষ্ট শব্দ ছাড়া আর কিছুই ধ্বনিত হচ্ছে না। রওশন ইজদানীর যন্ত্রণাকাতর মুখ আমাদেরও যন্ত্রণাবিদ্ধ করে তুললো। তাঁর বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে আমরা স্তদ্ধ হয়ে রইলাম, তাঁকে সান্ত¡না জানানোর কোনো ভাষা খুঁজে পেলাম না । আল্লাহর দরবারে নীরব প্রার্থনা জানালাম তাঁর রোগমুক্তির জন্যে। আর মনে মনে কামনা করলাম, এমন কঠিন ব্যাধি যেন আল্লাহ কাউকেই না দেন ।’
রওশন ইজদানী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ মে। হাসপাতালের ইস্যুকৃত একটি এ্যাটেন্ড্যান্ট পাস থেকে এ তথ্য জানা যায়। ১০ মে ইজদানী একটি পোস্টকার্ডে তাঁর গ্রামের পোস্টমাস্টার মফিজউদ্দিন মিয়ার উদ্দেশ্যে লিখেন,
‘উকিল মিঞা, আমার অসুখ বেশী। আজ থেকে সেক হবার কথা। আমার ঠিকানা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হসপিটাল ক্যান্সার ওয়ার্ড, বেড নং ১০। দোয়া করবেন। রওশন ইজদানী।’
হাসপাতালে রওশন ইজদানী মোট ২৯ দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। এরপর গ্রামের বাড়ি চলে আসেন। গ্রামের বাড়িতে এসে বেঁচে ছিলেন আরো ১৩ দিন। প্রয়াত হন ২০ জুন ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ; ৫ আষাঢ় ১৩৭৪ বঙ্গাব্দ। দিনটি ছিলো মঙ্গলবার, ক্ষণ সকাল সাড়ে আটটা।
প্রকাশনা
কবিতা ও গান
ভাঙ্গাবীনা (১৯৪৩); নীল দরিয়া (১৯৪৬); বন্ধের বাঁশী (১৯৪৭); বজ্রবাণী (১৯৪৭); তারানা-ই-ইজদানী (প্রকাশকাল জানা যায়নি); রাহগীর (১৯৪৯); রঙ্গিলা বন্ধু (১৯৫১); চিনু বিবি (১৯৫১); কয়েকটি কবিতা (১৯৬০); খাতামুন নবী-ঈন (১৯৬০)-হযরত মোহাম্মদ (দঃ)-এর জীবনালেখ্য; মৌলিক গণতন্ত্রের গান (১৯৫৯-৬০)-কবিতা সংকলন; পাকিস্তানের জঙ্গনামা(১৯৬৫); নয়া জামানা (১৯৬৫); ফরিয়াদ(১৯৮১); মরুর কাফেলা (১৯৮২)।
প্রবন্ধ
পাকিস্তান পরিকল্পনা (১৯৪৩); মোমেনশাহীর লোকসাহিত্য (১৯৫৮); পূর্ব পাকিস্তানের লোকসাহিত্য (১৯৬৬)।
জীবনী
ইসলাম জাহানের দুই সেতারা (প্রকাশকাল জানা যায়নি)।
গল্প
চলতি দুনিয়া (১৯৪৯); ইসলামী কথা (১৯৪৯-৫০)।
শিশু সাহিত্য
ছোটদের গল্প (১৯৪৯; এড়ি ও সোহাগী (১৯৭৯)।
পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত রচনা
ইউসুফ জুলেখা (১৯৫৭); দুলী; আইয়ুব খানের জারী (১৯৫৯); কলঙ্কিনীরূপী (১৯৬১); মোমেনশাহীর প্রাচীন পল্লী ও সমাজজীবন (গবেষণা গ্রন্থ)।
অন্যান্য গ্রন্থাবলী
খোলাফা-ই-রাশেদীন (১৯৭৯); মোমেনশাহীর লোক সাহিত্য; পূর্ব পাকিস্তানের লোক সাহিত্য।
পুরস্কার ও সম্মাননা
রওশন ইজদানী ‘খাতামুন নাবীঈন’ লিখে ১৯৬০ খ্রীস্টাব্দে সাহিত্য কর্মের জন্য আদমজী সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেছিলেন।