Tuesday, June 24, 2025
  • Login
  • হোম
  • পরিচিতি
  • প্রবন্ধ
  • কবিতা
  • গল্প
  • সাক্ষাৎকার
  • বই আলোচনা
  • আলোকচিত্র
  • প্রতিবেদন
  • অনুবাদ সাহিত্য
  • বিশেষ আয়োজন
  • বিবিধ
  • কবি-লেখকবৃন্দ
No Result
View All Result
  • হোম
  • পরিচিতি
  • প্রবন্ধ
  • কবিতা
  • গল্প
  • সাক্ষাৎকার
  • বই আলোচনা
  • আলোকচিত্র
  • প্রতিবেদন
  • অনুবাদ সাহিত্য
  • বিশেষ আয়োজন
  • বিবিধ
  • কবি-লেখকবৃন্দ
No Result
View All Result
No Result
View All Result
Home প্রবন্ধ

প্রবন্ধ।। সুফিয়া কামাল: ইতিহাসের সামগ্রিকতায় অনিবার্য এক নাম।। স্বপন পাল

Chatal by Chatal
June 20, 2025
in প্রবন্ধ
A A
0
প্রবন্ধ।। সুফিয়া কামাল: ইতিহাসের সামগ্রিকতায় অনিবার্য এক নাম।। স্বপন পাল

আমার কবিতা আর রাজনীতি একসূত্রে গাঁথা

‘প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের পর নারীর মুক্তিকে, অধিকারকে রাজনীতি এমনকি বিশ্বরাজনীতির সঙ্গে একাকার করে দেখেছেন সুফিয়া কামাল। আজ সর্বগ্রাসী পুঁজির পাটাতনে নারীমুক্তি নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, এটি তাঁদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বার্তা। আজকের নারীবাদ তাত্তি¦কভাবে অনেক এগিয়েছে সত্য। কিন্তু রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সঙ্গে তাঁদের আকাঙ্ক্ষা মেলাতে পারেনি বলে কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি। নারীর আন্দোলন অনেকটাই বি-রাজনীতিক করপোরেট পুঁজির বৃত্তে আটকে পড়েছে।’ কবি সুফিয়া কামালের ১১১ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ‘সুফিয়া কামাল ও নারীবাদী আন্দোলন’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক কাবেরী গায়েন এ কথা বলেন। কবি সুফিয়া কামাল নিজেকে কখনো নারীবাদী দাবি করেননি উল্লেখ করে কাবেরী গায়েন বলেন, ‘তাঁর মধ্যে একজন মাতৃরূপ প্রজ্বলিত রেখেছেন। নারীবাদীদের আশ্রয়স্থল ছিলেন তিনি। তিনি জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে (সরকারি রাজনীতির সঙ্গে নয়) নারী আন্দোলনের এক মেলবন্ধন ঘটাতে পেরেছেন, যা আজকের দিনের নারীবাদ চর্চাকারীদের মধ্যে অনুপস্থিত।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক আরো বলেন, ‘নারীর মুক্তিকে মানবমুক্তি হিসেবে দেখার যে মন্ত্র বেগম রোকেয়া ছড়িয়েছিলেন, সেই মন্ত্রে ও কাজে দীক্ষিত ছিলেন সুফিয়া কামাল। তাঁকে কেন্দ্র করেই রোকেয়া-পরবর্তী বাংলাদেশের নারী আন্দোলন অগ্রসর হতে থাকে। ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ গঠিত হওয়ার পরে এ দেশের নতুন নারীদের আন্দোলন-সংগ্রামের মশাল বাহক হয়ে ওঠেন সুফিয়া কামাল।’ সুফিয়া কামাল তার কবিতাকেও রাজনীতির বাইরে রাখেননি; তিনি বলেছেন, ‘যতদিন পর্যন্ত রাজনীতি বলতে মানবতাবোধের পুনরাধিষ্ঠান, সমতার অধিকার, মানুষের ভালো থাকা এবং ব্যক্তিগত ও সমাজ জীবনের উপর তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের কথা বোঝায়, আমার কবিতা আর রাজনীতি একসূত্রে গাঁথা।’

সুফিয়া কামালঃ জন্ম-বেড়ে উঠা-জীবন সংগ্রাম

১৯১১ খ্রীস্টাব্দের ২০ জুন বরিশালের শায়েস্তাবাদ নবাব পরিবারে সুফিয়া কামালের জন্ম। মা নবাবজাদী সাবেরা বানু এবং পিতা সৈয়দ আবদুল বারি পেশায় ছিলেন আইনজীবী, ভাষাপন্ডিত, আধ্যাত্মিক সাধক ও সুফি ঘরানার অনুসারী। সুফিয়ার সাত বছর বয়সের সময় পিতা গৃহত্যাগ করেন। নিরুদ্দেশ পিতার অনুপস্থিতিতে মা সৈয়দা সাবেরা খাতুনের পরিচর্যায় লালিত-পালিত হন সুফিয়া। শায়েস্তাগঞ্ছে নানার বাড়ির রক্ষণশীল অভিজাত পরিবেশে বড় হয়েও সুফিয়া’র মনোগঠনে দেশ, দেশের মানুষ ও সমাজ এবং ভাষা ও সংস্কৃতি মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। ‘একালে আমাদের কাল’-শীর্ষক আত্মজৈবনিক গ্রন্থে  তিনি লিখেছেন , ‘আমরা জন্মেছিলাম এক আশ্চর্যময় রূপায়ণের কালে। প্রথম মহাযুদ্ধ, স্বাধীনতা আন্দোলন, মুসলিম রেনেসাঁর পুনরুত্থান, রাশিয়ান বিপ্লব, বিজ্ঞান জগতের নতুন নতুন আবিষ্কার, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নবরূপ সূচনা, এসবের শুরু থেকে যে অভাবের মধ্যে শৈশব কেটেছে তারই আদর্শ আমাদের মনে ছাপ রেখেছে সুগভীর ভাবে।’

সুফিয়া কামাল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। তখনকার পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিবেশে বাস করেও তিনি নিজ চেষ্টায় হয়ে ওঠেন স্বশিক্ষিত এবং সুশিক্ষিত। বাড়িতে উর্দুর চল থাকলেও নিজেই বাংলা ভাষা শিখে নেন। রক্ষণশীলতার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে তিনি হয়ে উঠেন যথার্থভাবেই একজন আধুনিক মানুষ। রক্ষণশীল পারিবারিক পরিবেশ, আভিজাত্যের সংস্কার আর বাইরে থেকে নতুন দিনের উকিঝুঁকি-এর মধ্যে উনিশশো তেইশে মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সাথে বিয়ে হয় সুফিয়ার। বিয়ের পর তিনি সুফিয়া এন. হোসেন হিসেবে পরিচিত হন। নেহাল হোসেন ছিলেন একজন উদার প্রকৃতির মানুষ। তিনি সুফিয়াকে সমাজসেবা ও সাহিত্যচর্চায় উৎসাহ দেন। সাহিত্য ও সমসাময়িক পত্রিকার সঙ্গেও সুফিয়ার যোগাযোগও ঘটিয়ে দেন তিনি। এর ফলে সুফিয়া বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে আগ্রহী হয়ে উঠার পাশপাশি ধীরে ধীরে তিনি একটি সচেতন মনের অধিকারিণী হয়ে উঠেন।

পারিবারিকভাবে তখন নানা দুর্যোগের মুখোমুখিও হতে হয়েছিল। নদী ভাঙনে তিনশো বছরের জমিদারি গুটিয়ে আসছিল। জমিদারির দিন শেষ বুঝে নেহাল হোসেন পড়াশোনা শেষে আইনজ্ঞ হবেন মনে করে শায়েস্তাবাদ ছেড়ে প্রথমে বরিশাল শহরে এবং পরে কোলকাতায় পাড়ি জমান। সুফিয়া এন. হোসেনের কোলকাতা জীবনের শুরুটা ভালোভাবেই হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নেতাজী সুভাষ বসু, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, কাজী নজরুলের সাথে সাক্ষাৎ, ‘সওগাত’ গোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, বিশেষভাবে সওগাত সম্পাদক নাসিরউদ্দিন প্রমুখের প্রভাব ও সহযোগিতায় তাঁর জীবন বিকশিত হয়েছে। এদিকে দুর্ভোগ লেগেই ছিল। জমিদারি বিলুপ্তির সাথে সাথে আত্মীয়দের মধ্যে শুরু হয় বৈষয়িক দ্ব›দ্ব, আর এ সময়েই নেহাল হোসেনের বুকে দুরারোগ্য যক্ষ¥ারোগের লক্ষণ ধরা পড়ে। সব চিকিৎসা ব্যর্থ করে শেষ ক’টি দিন অসহ্য যন্ত্রণায় কাটিয়ে সুফিয়ার উৎসাহদাতা বন্ধু, সহমর্মী স্বামী নেহাল হোসেন মাত্র ২৫ বছর বয়সে পৃথিবী ত্যাগ করেন ১৯৩২ এ। তাঁদের কন্যা আমেনা খাতুনের বয়স তখন ছ’বছর।

বিলীয়মান জমিদারিতে বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ থাকায় সেদিক থেকে আয় কিছুই ছিল না। মেধাবী বড় ভাই ছাত্র-বৃত্তির টাকায় চলেন। সুফিয়ার কাঁধে তখন মা-মেয়ের দায়িত্ব। অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি। তবে একাদিক্রমে আঘাত আঘাতে ভিতরে ভিতরে শক্তও হয়ে উঠেছিলেন। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। কিন্তু যোগ্যতা? প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। হঠাৎ করেই নিজের অনন্য যোগ্যতাবলেই হয়ে গেল শিক্ষকতার চাকুরী। কলিকাতা কর্পোরেশনের শিক্ষা কর্মকর্তা ক্ষিতীশ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সাহিত্যামোদী মানুষ। সুফিয়ার কবি প্রতিভা তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সুফিয়ার পারিবারিক বিপর্যয়ের কথা জানতে পেরে তাঁকে কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা পদে চাকরির জন্য আবেদন করতে বলেন। সুফিয়া অবাক হন। তাঁর তো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তিনি কীভাবে শিক্ষকের পদে চাকুরি করবেন। ক্ষিতীশ চট্টোপাধ্যায় বলেন, যার লেখা প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া করতে এসে সবাই পড়বে, তাঁর নিজের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন নেই। সেই সময়ে সুফিয়ার একটি কবিতা, সম্ভবতঃ ‘পল্লীস্মৃতি’, কর্পোরেশন স্কুলের উর্ধ্বতন শ্রেণির পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে যাচ্ছিল। সুফিয়া আবেদন করলে তাঁর চাকরি হয়ে যায়। ঝড়ের একটা বড় ঝাপটা সামলে ছিলেন এইভাবে।

কিন্তু দুর্যোগ তখনো পিছু ছাড়েনি। স্কুলের কাজ, বাড়িতে মেয়ের দেখাশোনা, সাহিত্যচর্চার কারণে সামাজিক ব্যস্ততায় শরীরের ওপর চাপ বাড়ার পাশপাশি স্বামীহারা সংগ্রামরত মুসলিম নারীর প্রতি গোঁড়া সমাজের বৈরীদৃষ্টি তাঁর মানসিক ক্লেশের কারণ হয়ে উঠলো। ত্রিশের দশকের শেষের দিকে বিধ্বস্ত শরীর মন নিয়ে তিনি শয্যাশায়ী হলেন।  শুভাকাক্সক্ষী ও চিকিৎসকরা বুঝলেন এই সঙ্কটের সমাধান রয়েছে কেবল সস্নেহ সন্নিষ্ঠ বৈবাহিক জীবনে।  জানা যায় কাজী নজরুল ইসলামের আগ্রহে  সওগাত সম্পাদক নাসিরউদ্দিন এবং গৃহত্যাগী পিতার বন্ধু লেখক ও লোকহিতৈষী সরকারি কর্মকর্তা মীজানুর রহমান (সুফিয়া যাঁকে ‘আব্বু’ বলে ডাকতেন)-এর মধ্যস্থতায় বিয়ে হয় কামালউদ্দীনের সঙ্গে। কামালউদ্দীন সুফিয়ার কাব্য-প্রতিভা ও নারীমুক্তি সংগ্রামে তাঁর সাহসী ভূমিকার প্রতি আগে থেকেই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁর অসুস্থতার খোঁজ রাখতেন। অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে বিয়ের প্রস্তাবে তিনি দ্বিধাহীনভাবে বললেন- ‘সুফিয়া মারা যায় কি বাঁচে দুটোই হবে আমার ভাগ্য।’ বিয়ের পর সুফিয়া ক্রমশ সুস্থ হয়ে ওঠেন। শুরু হয় তাঁদের সৃষ্টিশীল যৌথজীবন।

বহু ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে গিয়েছে সুফিয়া কামালের জীবন। ২১ বছর বয়সে নেহাল হোসেনকে হারান (১৯৩২), হারান চিন্তা-চেতনা জাগরণের কেন্দ্রবিন্দু বেগম রোকেয়াকে (১৯৩২)। পারিবারিক অর্থনৈতিক অসহায়ত্ব তাকে নিঃশেষ করতে পারেনি। মা প্রয়াত হন ১৯৪১-এ। পুত্র শোয়েবকে হারান ১৯৬৩-তে। এরপরও মেরুদÐ সোজা করে হেঁটেছেন তিনি। অনেকেই তাঁকে সহযোগিতা করেছেন। সবার আগে বলতে হয় কামালউদ্দিন খানের নাম, যিনি ১৯৩৯-এ সুফিয়া কামালের করকমল হাতে তুলে নিয়ে ৩৮ বছর সুফিয়া কামালের দাম্পত্যজীবনের সঙ্গী হয়েছিলেন। স্বামী কামালউদ্দিন খান প্রয়াত হন ১৯৭৭-এ।

বিকশিত ধারায় জীবন প্রবাহ

সুফিয়া কামাল সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত হলেও, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে, বিশেষত নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। সুফিয়া কামাল বলেন, ‘চৌদ্দ বছর বয়সে বরিশালে প্রথমে সমাজ সেবার সুযোগ পাই। বাসন্তী দেবী ছিলেন অশ্বিনীকুমার দত্তের ভাইয়ের ছেলের বৌ। তার সঙ্গে দুঃস্থ মেয়েদের বিশেষ করে মা ও শিশুদের জন্য মাতৃসদনে আমি কাজ শুরু করি।’ ১৯২৫ সালে মহাত্মা গান্ধীর হাতে তুলে দেন নিজ হাতে চরকায় কাটা সূতা।   পরবর্তী সময়ে এই পথচলা আরও বিস্তৃত হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ‘‘প্রথম জীবনে কাজ করার পর আঠার থেকে বিশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রতিষ্ঠিত কলকাতার ‘আঞ্জুমান মাওয়াতিনে’ কাজ করি। এই প্রতিষ্ঠানের কাজ ছিল কলকাতার বস্তি এলাকার মুসলমান মেয়েদের মনোভাবে একটু শিক্ষিত করে তোলা। মিসেস হামিদা মোমেন, মিসেস শামসুন্নাহার মাহমুদ, সরলা রায়, জগদীশ বাবুর স্ত্রী অবলা বসু, ব্রহ্মকুমারী দেবী এরা সকলেই ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানে। আমার স্বামী ছিলেন উদার প্রকৃতির মানুষ, এসব কাজে তার কাছ থেকে প্রচুর উৎসাহ পেয়েছি আমি।’’

১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষের সময় বর্ধমানে এবং ’৪৬ এর ‘ডাইরেক্ট এ্যাকশন ডে’র হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর বিপন্ন এবং আহতদের মধ্যে কাজ করেছেন তিনি। এই সময়ই পরিচয় ঘটে সম-চিন্তার মানুষ হাজেরা মাহমুদ, রোকেয়া কবীর, হোসনা রশীদ ও নূরজাহান মুরশিদ এর সাথে। ১৯৪৭ এর পর ঢাকায় চলে আসেন। জীবনের এই পর্ব সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘প্রথমে ওয়ারি মহিলা সমিতি প্রতিষ্ঠিত করি এবং এই সমিতির মাধ্যমেই কাজ শুরু করি। প্রখ্যাত নেত্রী লীলা রায় আমাকে সমাজ কল্যাণের কাজে এগিয়ে আসতে আহবান জানান। এরপর পর্যায়ক্রমে ভাষা আন্দোলন, গণআন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে আমি বিশেষভাবে জড়িয়ে পড়ি।’

সুফিয়া কামাল ১৯৩১ সালে মুসলিম মহিলাদের মধ্যে প্রথম ‘ভারতীয় মহিলা ফেডারেশন’-এর সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৩৩-৪১ পর্যন্ত তিনি কলকাতা কর্পোরেশন পাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এই স্কুলেই তার পরিচয় হয় প্রাবন্ধিক আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪) এবং কবি জসীম উদ্দীন (১৯৩৩-১৯৭৬) এর সঙ্গে। ১৯৪৭ সালে ‘বেগম পত্রিকা’ প্রকাশিত হলে প্রথম সম্পাদক হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন কয়েক মাস। ১৯৪৮ সালে সুফিয়া ব্যাপকভাবে সমাজসেবা ও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। তিনি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি রক্ষার উদ্দেশ্যে শান্তি কমিটিতে যোগ দেন। এ বছরই তাকে সভানেত্রী করে ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি’ গঠিত হয়। ১৯৪৯ সালে তার যুগ্ম সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সুলতানা পত্রিকা, যার নামকরণ করা হয় বেগম রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্ন গ্রন্থের প্রধান চরিত্রের নামানুসারে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সুফিয়া কামাল সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর দমন-নীতির অঙ্গ হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে তিনি তার বিরুদ্ধেও তীব্র প্রতিবাদ জানান। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষে তিনি ‘সাংস্কৃতিক স্বাধিকার আন্দোলন’ পরিচালনা করেন। ১৯৬৯ সালে ‘মহিলা সংগ্রাম পরিষদ’ (বর্তমানে-বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ) গঠিত হলে তিনি প্রতিষ্ঠাতা প্রধান নির্বাচিত হন এবং আজীবন তিনি এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। স্বাধীনতার পরও সুফিয়া কামাল অনেক সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন। তিনি প্রতিষ্ঠা-প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশ মহিলা পুনবার্সন বোর্ড, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন কমিটি, দুঃস্থ পুনর্বাসন সংস্থার; ছিলেন ছায়ানট, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন, নারী কল্যাণ সংস্থার সভানেত্রী।

পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র- ক্রমাগত ক্ষুদ্র গন্ডি থেকে বৃহৎ আঙিনার দিকে এগিয়ে গিয়েছেন তিনি। রাষ্ট্রের ইতিবাচক রূপান্তরে তাকে পাওয়া গেছে সব সময়।

রবীন্দ্র-নজরুল ¯ স্নেহে  ধন্য সুফিয়া কামাল

মাত্র বার বছর বয়সে, ১৯২৩ সালে তাঁর প্রথম রচনা ‘সৈনিক বধু’ (গল্প) প্রকাশিত হয় বরিশালের ‘তরুণ’ পত্রিকায়। বিখ্যাত ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতা ‘বাসন্তী’ ১৯২৬ এ, পনের বছর বয়সে; সাথে সাথেই তা সাহিত্য সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সামাজিক, পারিবারিক বাধা ভেঙ্গে বাঙালি পাইলটচালিত বিমানে চড়েন ১৯২৮ এ। ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয় ‘সাঁঝের মায়া’ কাব্যগ্রন্থ। এর ভূমিকা লিখেছিলেন নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথ এটি পড়ে উচ্ছসিত প্রশংসা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠিতে সুফিয়া এন. হোসেন (তাঁর তখনকার পরিচয়)কে লেখেন, ‘তোমার কবিত্ব আমাকে বিস্মিত করে। বাংলা সাহিত্যে তোমার স্থান উচ্চে এবং ধ্রæব তোমার প্রতিষ্ঠা। আমার আশীর্বাদ গ্রহণ করো।’ শুধু সাহিত্যে নয়, বাংলাদেশের জনগণের মানসভূবনে বেগম সুফিয়া কামাল স্বকীয় ঠাঁই করে নিয়েছেন নিজ কর্মের মাধ্যমে। ‘সাঁঝের মায়া’ কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘কবি সুফিয়া এন হোসেন বাংলার কাব্যগগণে উদয়তারা। অস্ততোরণ হতে আমি তাঁকে যে বিস্মিত মুগ্ধচিত্তে আমার অভিনন্দন জানাতে পারলাম, এ আনন্দ আমার স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ ভূমিকার অন্যত্র তিনি লিখেন, ‘তাঁর স্বর্গত স্বামী আমার অনুজপ্রতিম বন্ধু সৈয়দ নেহাল হোসেন সাহেব আমায় কয়েকটি কবিতা দেখতে দিলেন। আমার বিশ্বাস হলো না যে, সে কবিতা কোনো মুসলিম বালিকার লেখা।’ নজরুল মনে করেছেন, এই কবিতাগুলি ‘বদ্ধ বুলবুলের অবগুণ্ঠনের বাধা অতিক্রম করে দিগদিগন্তে ধ্বনিত’ হয়েছে।

সাঁঝের মায়া ছাড়াও তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ: মায়া কাজল, মন ও জীবন, প্রশস্তি ও প্রার্থনা, উদাত্ত পৃথিবী, দিওয়ান, অভিযাত্রিক, মৃত্তিকার ঘ্রাণ, মোর জাদুদের সমাধি পরে। তার শিশুতোষ কাব্যগ্রন্থ হলো, ‘ইতল বিতল’, ‘নওল কিশোরের দরবার’। সুফিয়া কামালের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘একালে আমাদের কাল’। তিনি ছোটগল্প এবং ক্ষুদ্র উপন্যাসও রচনা করেছেন। ‘কেয়ার কাঁটা’ তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্প গ্রন্থ। আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো; ‘সোভিয়েতের দিনগুলি’ (ভ্রমণ), একাত্তরের ডায়েরী (স্মৃতিকথা) ইত্যাদি। তার কবিতা চীনা, ইংরেজি, জার্মান, ইতালিয়ান, পোলিশ, রুশ, ভিয়েতনামিজ, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৮৪ সালে রুশ ভাষায় ‘সাঁঝের মায়া’ গ্রন্থটি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়ও তার বেশ কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়। ২০০১ সালে বাংলা একাডেমি সুফিয়া কামালের কিছু কবিতার ইংরেজি অনুবাদ দিয়ে গড়ঃযবৎ ড়ভ চবধৎং ধহফ ড়ঃযবৎ ঢ়ড়বস এবং ২০০২ সালে সুফিয়া কামালের রচনা সমগ্র প্রকাশ করেছে। অগন্থিত গদ্যের মধ্যে রয়েছে একটি অসম্পূর্ণ উপন্যাস-‘অন্তরা’। বৈশাখ ১৩৪৫ থেকে পাঁচ কিস্তিতে ‘অন্তরা’ প্রকাশিত হয় কলকাতার ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকায়। আছে ছোট্ট একটি উপন্যাস (ঘড়াবষষধ) ‘জনক’। ঢাকা থেকে প্রকাশিত নূরজাহান বেগম সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক বেগম’ পত্রিকায় ১২ সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় (৩০ বর্ষ ৩৭ থেকে ৪৮ সংখ্যা, ১৯ মার্চ, ১৯৭৬ থেকে ৪ জুন, ১৯৭৮)।

কেবল সাহিত্যিক নয়, ইতিহাসের সামগ্রিকতায় অনিবার্য নাম সুফিয়া কামাল

‘সত্যিই তো কতটুকু ভাবি আমরা বাঙালি নারী লেখকদের ভূমিকা নিয়ে? গুরুত্বপূর্ণ কোনো পাঠ কি আমরা তৈরি করতে পেরেছি স্বর্ণকুমারী দেবী, গিরীন্দ্রমোহন দাসী, বেগম রোকেয়া, জ্যোতির্ময়ী দেবী কিংবা সুফিয়া কামাল প্রসঙ্গে? পারিনি। তর্ক ওঠে নারী কবি লেখকদের বিষয়ের বৈচিত্র্যহীনতা কিংবা নির্মাণ কলা প্রকৌশলের ‘সীমাবদ্ধতা’ নিয়ে। লৈঙ্গিক সম্পর্কের মাপকাঠিতে কেন নারী-পুরুষ আলাদা করা হবে? এমন প্রশ্নও তোলা হয়। কিন্তু পাল্টা পর্যবেক্ষণ হিসেবে এ কথা উচ্চারিত হয় না যে, লৈঙ্গিক আধিপত্য শাসিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিবেশে নারীর সাহিত্যও বৈষম্যের শিকার হয়েছে। পুরুষের সাহিত্য চর্চা যখন নন্দন তাত্তি¡ক বিলাসের বস্তু, নারীর সাহিত্য চর্চা তখন ছিল অস্তিত্ব আবিষ্কার, প্রকাশ ও রক্ষার মাধ্যম।’(সুমন সাজ্জাদ: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়)।

একশো দেড়শো বছর আগে একজন রাসসুন্দরী দেবী, স্বর্ণকুমারী দেবী, রোকেয়া হওয়া মোটেই সহজ ব্যাপার ছিল না। কিংবা তারও আগে একজন বিদ্যাবতীর কথাই যদি ভাবি আমরা! লড়াইয়ের নানা পর্যায় পেরিয়েই নারীকে পৌঁছুতে হয়েছে লেখালেখির আঙিনায়। সুফিয়া কামালকে বিচার করতে হবে সেই শত বর্ষ আগের প্রেক্ষাপটেই।  সমাজ কর্তৃক তার জন্যেও নানা সময়ে যথারীতি উঠেছিল নিষেধের তর্জনী। সুফিয়া কামাল তা মানেননি; হেঁটেছেন আত্ম-নির্মাণের পথে। তবে একা একা হাঁটেননি; যূথবদ্ধ লড়াইয়ে সঙ্গী করেছেন অপরাপর নারীকে। এই প্রসঙ্গে এও মনে রাখা জরুরী যে, শুধু সামাজিক প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় আনলেই হবে না, সাহিত্যের আঙিনায় তাঁর পদচারণাকে কিভাবে নিয়েছিল? ১৩৩৭ বঙ্গাব্দে যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত ‘বঙ্গের মহিলা কবি’ নামক গ্রন্থে আলোচিত হয়েছিল গিরীন্দ্রমোহন দাসী, কামিনী রায়, মানকুমারী বসুসহ অনেক বাঙালি নারী কবিকে নিয়ে। বঙ্গ দেশে তখন আজকের অর্থে নারীবাদ ও নারীবাদী সাহিত্য তত্তে¦র চর্চা ছিল না। সে সময়ে যোগেন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘মহিলা কবিদের প্রত্যেকের কবিতায়ই একটা বিষাদের সুর, একটা নিরাশার সুর প্রবাহিত, এই বিশেষত্বটুকু সকলেরই চক্ষে পড়িবে।’ হ্যাঁ এটিও ঠিক। তবে সেই বিষাদ, সেই নিরাশার অতলে সঞ্চিত ব্যথা কি ছিল, সেটাও সচেতন বিবেচনায় রাখতে হবে।

আধুনিক নারীর ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে অন্য এক আধুনিকতার ইতিহাস। এখন নারীরা লিখছেন, সম্পাদনা করছেন। কিন্তু সেই সময়ের নারীদের জন্য লেখালেখি ছিল অনেকটাই মানসিক স্বস্তির দুয়ার খোলা। উনিশ শতকে কত নারী বৈধব্যের যন্ত্রণাকে মুদ্রিত করেছেন সংবাদপত্রের পাতায়। সেসবের খবর খুব বেশি নেইনি আমরা। জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে’রা যখন লেখালেখির কৌশল-বৈচিত্র্য নিয়ে ভাবছেন তখন স্বর্ণকুমারী দেবী,  রোকেয়া কিংবা সুফিয়া কামালকে ভাবতে হচ্ছে লেখাপড়া, পর্দাপথা, ধর্মীয় অনুশাসন, সংসার, দাম্পত্য বিষয়ে। সামাজিক বিধিনিষেধের বেড়াজাল পেরিয়ে তবেই না কাগজে কলমের আঁকাআঁকি করতে হয়েছে। এমন বাস্তবতায় সুফিয়া কামাল লিখেছেন, ভেবেছেন, সমাজ বদলের স্লোগান দিয়েছেন এবং হয়ে উঠেছেন ইতিহাসের চরিত্র। তাঁর নাম হয়েছে ‘জননী সাহসিকা’। ‘বহু কাল ধরেই বাঙালির চিন্তায় নারীর জননী রূপ প্রভাবশালী। যদিও সমাজের অভ্যন্তর কাঠামো প্রবলভাবে নিয়ন্ত্রিত পুরুষতান্ত্রিক ভাবাদর্শ দ্বারা। সুফিয়া কামালের মাতৃমূর্তি দেশীয় পরিসরে নতুন করে জানান দিয়েছে নারী শক্তি, নারী স্নেহ, নারী ক্ষমতা। ইচ্ছেমতো পুতুল খেলার নারী সে নয়। নারীর স্নায়ু শিরায় রক্তপ্রবাহে আছে সাহস। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে সুফিয়া কামাল হয়ে উঠলেন সাহসী নারী ও জননীর প্রতীক।’ এটিও আকস্মিক ছিল না। সমাজ ও সংস্কৃতির ভেতর এই ভাবনা যোগ করেছিল অন্য দ্যোতনা। মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষিত নিপীড়িত নারী ‘বীরাঙ্গনা’ অভিধা পেলেও সমাজের স্বীকৃতি মেলেনি। ইতিহাসও হয়ে উঠেছিল পুরুষ পক্ষীয়। তখন সুফিয়া কামাল অবতীর্ণ হয়েছিলেন সাহসীকার ভূমিকায়; আর এই বার্তাই দিয়েছিলেন, মেয়েরা পারে; মেয়েরা ভাঙতেও পারে, গড়তেও পারে।

বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে জ্বলজ্বলে হয়ে উঠেন একজন সুফিয়া কামাল। তাই সাহিত্য অথবা সমাজ অথবা রাজনীতি অথবা নারীর যেকোনো একটি মানদন্ডে নয়, সুফিয়া কামালকে দেখতে সমগ্রের প্রেক্ষাপটে। ইতিহাসের সামগ্রিকতায় অনিবার্য নাম সুফিয়া কামাল।

সম্মাননা-পুরস্কার

সাহিত্যচর্চার জন্য সুফিয়া কামাল অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ১৯৬১ সালে তিনি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ‘তঘমা-ই-ইমতিয়াজ’ নামক জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন; কিন্তু ১৯৬৯ সালে বাঙালিদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি তা বর্জন করেন। উল্লেখযোগ্য আরও কয়েকটি পুরস্কার ও পদক হলো: বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬২), একুশে পদক (১৯৭৬), জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার (১৯৯৫), Women’s Federation for World Peace Crest (১৯৯৬), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬), দেশবন্ধু চিত্তরঞ্ছন দাশ স্বর্ণপদক (১৯৯৬), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৭) ইত্যাদি। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের Lenin Centenary Jubilee Medel (১৯৭০) এবং Czechoslovakia Medal (১৯৮৬)সহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও লাভ করেন।

নিঃশ্বাস নিঃশেষ হোক পুষ্প-বিকাশের প্রয়োজনে

সুফিয়া কামাল সাহিত্যিক হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও বুদ্ধিজীবী, সমাজকর্মী ও একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে তার ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে উজ্জ্বল। তার সময়কালে পশ্চাৎপদ মুসলিম সমাজের একজন নারী হিসেবে সীমাবদ্ধ গন্ডি পেরিয়ে সমাজ-দেশের বড় প্রেক্ষাপটে ভূমিকা রাখা কেবলই গৌরবের ছিল না, এটি ছিল সাহসের এবং যুগান্তকারী।

সুফিয়া কামাল সারা জীবন ধরে নারী-মুক্তির দিগন্ত উন্মোচন করার জন্য কাজ করেছেন। যদিও এর জন্যে আরও অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। নূরজাহান মুরশিদের সাথে এক সাক্ষাতকারে সুফিয়া কামাল বলেন, ‘আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লাগে এই দেখে যে, মেয়েরা আগের তুলনায় এখন অনেক সাহসী হয়েছে। মেয়েরা এখন রাস্তায় বেরিয়ে অন্তত নিজেদের কথা বলতে শিখেছে। আমরা চেয়েছিলাম, মেয়েরা কথা বলতে শিখুক, সাহসী হয়ে উঠুক, নিজেদের অধিকার তারা বুঝতে পারুক। এটা এখন হয়েছে। এটা বড়ো আনন্দের। ( নূরজাহান মুরশিদ, বেগম সুফিয়া কামালের মুখোমুখি, একাল, ঢাকা, দ্বিতীয় সংখ্যা, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৮৬)। এ প্রসঙ্গে সুফিয়া কামালের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধগত বিবেচনাও আমাদের জন্য শিক্ষনীয়। তিনি নারী স্বাধীনতার সাথে নীতি-আদর্শ-ঐতিহ্যকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মেয়েরা স্বাধীনতা পেয়েছে। কিন্তু অনেকেই সেই স্বাধীনতার ব্যবহার সব সময় সঠিকভাবে করতে শেখেনি। অনেক সময় অপব্যবহার করছে। এটা আমার কাছে খুব খারাপ লাগে।… নারীদের যেন কোনো পণ্য না করা হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।’ (কুররাতুল আইন তাহমিনা, শুভ জন্মদিন সুফিয়া কামাল, ভোরের কাগজ, ঢাকা, ২০ জুন ১৯৯৮)।

দেশের কাজ এবং ইতিহাসের দায় সুফিয়া কামালকে সবসময়ে ব্যস্ত রেখেছে এবং এই কারণে তাঁকে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে কখনো কখনো কঠোরও হতে হয়েছে। ইতিহাসের নানা ঘূর্ণিপাক, বাঁক তিনি পেরিয়েছেন সাবলীল স্বচ্ছতায়।

সুফিয়া কামাল রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির কথা ভেবেছেন, অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে প্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়ার কথাও বলেছেন। মানুষে মানুষে সম্প্রীতি ও সাম্য তার লেখা ও কর্মকান্ডের ভিত্তিমূল হিসেবে কাজ করেছে।

১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর, শনিবার সকাল সাড়ে আটটায় প্রয়াত হন আমাদের ইতিহাসের অনিবার্য মানুষ সুফিয়া কামাল ।

১৯২৯ খ্রীস্টাব্দের ২৩ জুলাই, মাত্র ১৮ বছর বয়সে ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিনকে লিখেছিলেন, ‘আমি আমার কাজ করে যাব নীরবে, নিশ্বব্দে। আমি পথের কাঁটা সরিয়ে যাব-এরপর যারা আসবে যেন কাঁটা না ফুটে তাদের পায়ে, তারা যেনো কণ্টকবিদ্ধ পদে পিছিয়ে না পড়ে। ওইটুকু আমি করবো আমার যতটুকু শক্তি আছে তা দিয়ে।’ (উদ্ধৃত, আনিসুজ্জামান, ২০০২) তিনি তাই করে গিয়েছেন জীবনভর। সুফিয়া কামালের আত্মজা মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব সুলতানা কামাল এক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘সুফিয়া কামাল আত্মশক্তিতে বিশ্বাস করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, যত বাধা আসুক, সে বাধাকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আর নিজেকে সেটার জন্য তৈরি করতে হবে, যোগ্য করতে হবে। সংঘমিত্র হতে হবে, অর্থাৎ অবস্থান নিতে হবে। কাজ করতে হবে, সকলকে সংগঠিত হতে হবে।’ তিনি এও বলেন, ‘আসুন, আত্মশক্তিকে চেনার চেষ্টা করি, আত্মসম্মান জাগুত করার চেষ্টা করি। দাবি করি, মানুষ হিসেবে মানুষের জন্য যা প্রাপ্য, নিজের জন্য চাই, সবার জন্য চাই।’ একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতা ও সিদ্ধান্তহীনতা বাংলাদেশের এমনকি সারা বিশে^র মানুষের ‘সবচেয়ে বড় সংকট’ হিসেবে যখন দেখা দিয়েছে, তখন সবার ‘সংঘমিত্র’ হওয়াটা জরুরি। ‘সংঘমিত্র’ হয়ে মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আরও প্রত্যয়ী হওয়ার মাধ্যমে স্মরণে-বরণে-মননে রাখতে হবে কালের পথ-দিশারী সুফিয়া কামালকে।

এটিও মনে রাখতে হবে, এই যে আমরা সুফিয়া কামালকে স্মরণ করছি, তাঁকে নিয়ে এতো কথা বলছি, এতে তাঁর কিছু আসে যায় না। আমাদের কারণেই তাঁকে আমাদের স্মরণ করতে হবে প্রতিনিয়ত। মুক্তির যে আলো তিনি প্রজ্জ্বলিত করে দিয়ে গেছেন, সেখান থেকে আলো নিয়ে  ছড়িয়ে দিতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। এভাবেই  আলোকিত হয়ে উঠবে পথরেখা, আর সেই পথরেখা ধরে হাঁটতে হাঁটতে মুক্তির কাক্সিক্ষত ঠিকানায় পৌঁছবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

আজকের শ্রদ্ধাঞ্জলি শেষ করি কবি’র লেখা কবিতার দু’লাইন দিয়েই,-

‘মুক্তি লবে বন্দী আত্মা-সুন্দরের স্বপ্নে, আয়োজনে,

নিঃশ্বাস নিঃশেষ হোক পুষ্প-বিকাশের প্রয়োজনে।’

সহায়ক সূত্র: একালে আমাদের কাল; সুফিয়া কামাল। কামালউদ্দীন খান স্মারকগ্রন্থ। সুফিয়া কামাল-আমাদের ‘ভোরের পাখি’; কুদরত-ই-হুদা। সুফিয়া কামাল-কেন তাকে মনে রাখবো; সুমন সাজ্জাদ।  সুফিয়া কামাল ও নারীবাদী আন্দোলন; কাবেরী গায়েন  ও উইকিপিডিয়া।

 

স্বপন পাল- কবি ও প্রাবন্ধিক। জন্ম ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ৯ জানুয়ারি। পিতা স্বৰ্গীয় সন্তোষ কুমার পাল, মাতা নির্মলা বাসিনী পাল। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর স্বপন পাল-এর লেখালেখি শুরু ছাত্রজীবন থেকেই। ছাত্রজীবনে ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা ‘বজ্র’র নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সক্রিয় ছিলেন ছাত্র সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বই প্রবন্ধ ও জীবনী: ডিরোজিও : মুক্তচিন্তার পথিকৃৎ, রবীন্দ্রনাথ গান্ধী সুভাষ পারস্পরিকতা, নো নেশন ও রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি, অক্টোবর বিপ্লব ও রবীন্দ্রনাথ, আনন্দমোহন বসু : ইতিহাসের অপ্রকাশিত অধ্যায় [মৃন্ময় পাল সংলাপ-এর সঙ্গে যৌথভাবে] সামাজিক শক্তির বিকাশ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ [সংকলন] নজরুল: এ লিভিং লিঙ্ক, কালান্তরের পথনির্মাতা-কাদম্বিনী, রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ: কাছে ও দূরে। উপন্যাস ময়মনসিংহ জংশন। কবিতা জীবনটাকে ছোঁব বলে, আমাকে উপেক্ষা করো এমন শক্তি কোথায়। বর্তমানে একটি বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
Tags: চাতালপ্রবন্ধসুফিয়া কামালস্বপন পাল
Previous Post

প্রবন্ধ।। ‘লিচুর বাগানে’ গানের গীতিকার কে? ।। সঞ্জয় সরকার

Next Post

প্রবন্ধ।। সৃষ্টিশীলতার নৈতিকতা এবং সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।। আল মাকসুদ

Chatal

Chatal

Next Post
প্রবন্ধ।। সৃষ্টিশীলতার নৈতিকতা এবং সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।। আল মাকসুদ

প্রবন্ধ।। সৃষ্টিশীলতার নৈতিকতা এবং সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।। আল মাকসুদ

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • About
  • Advertise
  • Privacy & Policy
  • Contact
বাংলামটর, ঢাকা-১০০০, বাংলাদেশ।
ই-মেইল: [email protected]

© 2021 Chatalbd - Design & Developed By Developer Rejwan.

No Result
View All Result
  • হোম
  • পরিচিতি
  • প্রবন্ধ
  • কবিতা
  • গল্প
  • সাক্ষাৎকার
  • বই আলোচনা
  • আলোকচিত্র
  • প্রতিবেদন
  • অনুবাদ সাহিত্য
  • বিশেষ আয়োজন
  • বিবিধ
  • কবি-লেখকবৃন্দ

© 2021 Chatalbd - Design & Developed By Developer Rejwan.

Welcome Back!

Login to your account below

Forgotten Password?

Retrieve your password

Please enter your username or email address to reset your password.

Log In