Friday, May 9, 2025
  • Login
  • হোম
  • পরিচিতি
  • প্রবন্ধ
  • কবিতা
  • গল্প
  • সাক্ষাৎকার
  • বই আলোচনা
  • আলোকচিত্র
  • প্রতিবেদন
  • অনুবাদ সাহিত্য
  • বিশেষ আয়োজন
  • বিবিধ
  • কবি-লেখকবৃন্দ
No Result
View All Result
  • হোম
  • পরিচিতি
  • প্রবন্ধ
  • কবিতা
  • গল্প
  • সাক্ষাৎকার
  • বই আলোচনা
  • আলোকচিত্র
  • প্রতিবেদন
  • অনুবাদ সাহিত্য
  • বিশেষ আয়োজন
  • বিবিধ
  • কবি-লেখকবৃন্দ
No Result
View All Result
No Result
View All Result
Home বিশেষ আয়োজন

প্রবন্ধ।। লোকসংস্কৃতিতে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ।। হাসান ইকবাল

Chatal by Chatal
March 29, 2022
in বিশেষ আয়োজন
A A
0
প্রবন্ধ।। লোকসংস্কৃতিতে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ।। হাসান ইকবাল

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির অনেক জায়গা জুড়ে রয়েছে প্রাচীন লোকসাহিত্য। লোকসাহিত্যের একটি উলে¬খযোগ্য শাখা বাউল গান, পুঁথি, ভাটকবিতা, গম্ভীরা গান, জারি সারি ইত্যাদি। নিভৃত গ্রামীণ জনপদে বসবাস করলেও বাংলার ভাটকবি, চারণকবি, ছড়াকার, নাট্যকার, বাউল-কবিয়াল, জারিসারি গানের রচয়িতাগণ দেশের চলমান ঘটনাপ্রবাহ আন্দোলন সংক্রান্ত সংঘর্ষ, রক্তপাত, শোষন-নির্যাতন, সন্ত্রাস, রাজনৈতিক উত্থান-পতন, গণআন্দোলন, নির্বাচন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা উত্তর দেশের অবস্থার প্রতি সজাগ ছিলেন- যা তাদের রচিত গান, ছড়াকবিতা, যাত্রা-নাটক, পালা, জারি সারি এবং ভাটকবিতায় ফুটে উঠে এবং এসবের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণ দেশ ও মাটির চলমান নানা ঘটনাপ্রবাহ ও চালচিত্র সম্পর্কে অবহিত হয়ে উদ্দীপ্ত হয় এবং জাতীয় আন্দোলন সংগ্রামে এগিয়ে আসে। লোকসংস্কৃতির নানান অনুষঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গটি যেমন উঠে এসেছে ঠিক তেমনি উঠে এসেছে বাঙালীর মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নানান বিশ্লেষণ। সেটা কবিতা, গল্পগানে যেমন লেখা হয়েছে, লেখা হয়েছে বাংলাসাহিত্যের লোকসংস্কৃতির উপাদানেও।

পলাশীর প্রান্তরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে ষড়যন্ত্রে পরাজিত হয়ে আমাদের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হলেও সেই স্বাধীনতা ফিরে পেতে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘদিন। অনেক সংগ্রাম আর লক্ষ প্রাণের রক্ত, নানান বঞ্চনা আর শোষণের ইতিহাস পেছনে ফেলে আমরা দেখা পেয়েছি স্বাধীনতার সুবর্ণ কীরিট। এর মাঝে আমাদের পার করতে হয়েছে দুটি দেশের শাসন ও শোষণের দীর্ঘ প্রক্রিয়া। ইংরেজদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পরই আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে পাকিস্তানী শাষণের ভূত। এর মাঝের ইতিহাস শুধুই অপ্রাপ্তি হতাশা আর শোষণের। এর বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ শুরু হয় ১৯৭১-এ। মুক্তিপাগল বাঙালি পরাধীনতার গ্লানি মুছে ফেলতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সংগ্রামে – শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, লক্ষ প্রাণ আর হাজার মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। তাই আমাদের সব মানুষের প্রিয় শব্দ এটি- স্বাধীনতা। স্বাধীনতা- এই শব্দটির সঙ্গে মানুষ তার নিবিড় একাত্মতা অনুভব করে। কারণ প্রতিটি মানুষমাত্রই আকাঙ্খা থাকে স্বাধীনতার সীমাহীন নীলিমায় ওড়ার। আর এই স্বাধীনতা যদি হয় রক্তের বিনিময়ে – অনেক সংগ্রামের বিনিময়ে, তাহলে তার স্বাদটাও পাল্টে যায়। তখন এই স্বাধীনতা হয়ে ওঠে আরও বেশি অর্থবহ- অনেক বেশি আনন্দের উপলক্ষ্য।

বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে লোকসংস্কৃতির অনেক অনুষঙ্গই এখন দুষ্প্রাপ্য এবং বিলুপ্তির পথে। যেমন-পুঁথি, বাউল গান, যাত্রাপালা, ভাটকবিতা, গম্ভীরা গান প্রভৃতি। লোকসংস্কৃতির নানান উপাদান নিয়ে গান কবিতা এখন লেখাও হয়না এবং চর্চাও নেই। বাংলাদেশে যে সময়টাতে লোকসংস্কৃতির এসব উপাদানের বিকাশ ঘটেছিল সে সময়টাতে গ্রামের সাধারণ মানুষের বিনোদনের মাধ্যমও ছিল এগুলো। তাই গ্রামের অনকে নিরক্ষর কবি, গীতালু, বাউল, কবিরা সে সময়টিকে তাদের লেখায়, গানে, কবিতায় নিঁখুতভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। গ্রামের কবিয়ালগণ তাদের লেখনীতে যুদ্ধের সেই সময়কার ছবি একেছিলেন নিঁখুতভাবে। এ প্রবন্ধে স্বল্প পরিসরে কিছু পুঁথি, ভাটকবিতা, বাউলগান উদ্ধৃতি করার পাশাপাশি সংক্ষিপ্ত আলোচনা সন্নিবেশ করেছি- এতে করে নতুন প্রজন্মের পাঠকরা কিছুটা হলেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে। লোকসংস্কৃতির এসব কুড়ানো মানিকে যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঠিক চিত্র ফুটে উঠেছে- তা থেকে পাঠক, গবেষক মুক্তিযুদ্ধের অনেক ইতিহাসই নিতে পারবে বলে আমি মনে করি। এসব সংকলিত  কবিতায় সুষ্পষ্টভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়। গ্রামের বাউলকবিরা তাদের আত্ম উপলব্ধি ও দেশপ্রেমের জায়গা থেকে কবিতার যে শব্দবুনন শুরু করেছিলেন তা আমাদের ইতিহাসের মূল্যবান দলিল।

দেশের জনগনকে সচেতন ও উদ্দীপ্ত করার লক্ষ্যে গ্রাম বাংলার লোককবি, পালাকার, গীতিকার, সুরকার, নাট্যকার, জারি সারি, পল্লীকবি, লোকগান ও ভাটকবিতার রচয়িতাগণ বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলন, সংগ্রাম, সংঘর্ষ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-র নির্বাচন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসন, ছয় দফা, ১১ দফা, ৬৯-র গণ আন্দোলন, ৭০-র নির্বাচন ও নির্বাচন উত্তর ঘটনাপ্রবাহ, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ, স্বাধীনতা সংগ্রাম, পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহিনীর নűশংস হত্যাযজ্ঞ এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচনা করেছেন অসংখ্য কবিতা ছড়া, যাত্রা পালা, ভাওয়াইয়া ও লোকগাঁথা। লোককবি ও লোকশিল্পীগণ তা যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্পে পরিবেশন করে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। অজ্ঞাতনামা অনেক লোককবিদের রচিত কবিতা গানে ও ছড়ায় গণআন্দোলনের চিত্র অম্লান হয়ে আছে। টিপু পাগলার বিদ্রোহ, তিতুমীরের সংগ্রাম, ক্ষুদিরামের আত্মবলিদান, স্বদেশী আন্দোলন ভাষা আন্দোলন, ১১ দফা ও ৬ দফা আন্দোলন, এমনকি বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ স্বতঃস্ফুর্ত আবেগের প্রেরণায় লোককবিদের কাছে ধরা দেয়।

একটি জাতির সমাজ মনস্তত্ত্ব, ব্যক্তি মনস্তত্ত্ব, চিন্তাধারা, তার কর্মজীবনের উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে লোকসংস্কৃতির নানান অনুষঙ্গে। আর এভাবেই যুগ যুগ ধরে একটি দেশ বা জাতি তার শোষকের নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে নানান কাব্যকথা, গানের মাধ্যমে। তাদের গানে যুক্ত হয়েছে পলাশীর যুদ্ধের স্মৃতি, নীল বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলনসহ নানা আন্দোলনের ভয়াবহ ছবি। ক্ষুদিরামের আত্মবলিদানের কথাও  উঠে এসেছে লোকসংস্কৃতির লোকগানের করুণ সুরে সুরে। এছাড়াও ভাষা আন্দোলন, ১১ দফা, ৬ দফাসহ যুদ্ধের নানা প্রসঙ্গ লোকগানে ধরা পড়েছে। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর দীর্ঘ ২৪ বছর পাকিস্তান শাষকদের শোষণ-বঞ্চনার জাঁতাকলে নিষ্পেশিত হয়েছে বাঙালি জাতি। তাও বাদ যায়নি লোককবিদের কলমের ডগা থেকে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ইতিহাসের পটভূমি অনেক সুদূরে প্রোথিত। আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সাথে বৈষম্যমূলক আচরন শুরু করে পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী। তারা কর্মক্ষেত্র, আমদানি-রপ্তানি চাকরি, শিল্পকারখানা স্থাপন এবং নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের পরিচয় দেয়। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৪৪% লোক বাস করত পশ্চিম পাকিস্তানে আর এদের উন্নয়নের জন্য বাজেট বরাদ্দ ছিল ৭৭% আর পূর্ব বাংলার ৫৬% জনসংখ্যার জন্য বরাদ্দ রাখা হতো ২৩%। এরকম বৈষ্যমের মর্মান্তিক বর্ণনা আমরা অনুধাবন করতে পারি এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষের লোকগানে যা ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল। রঞ্জনা বিশ্বাস তার লেখা ‘লোকসাহিত্যে বঙ্গবন্ধু’ প্রবন্ধে এর সুন্দর তথ্য দিয়েছেন। তার উদ্ধৃতি দিয়েই শুরু করা যাক। উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্র অঞ্চলের আলকাপ গানের বন্দনা অংশে শোনা যায়-

ভোলা তুই

পালারে ভাই পালা,

আল্লা তোকে সুমতি দিক

ছেড়ে যারে বাংলা

তোর শাসন-শোষণ হামরা

হইনু জর জর,

ধর্মের দোহাই পেড়ে দাগো

শোষণ হাতিয়ার।

হামার দ্যাশের পণ্য দিয়া

সোনা চান্দি আনো

পশ্চিম পাকিস্তানে সোনা

বসে বসে গনো।

হামরা হৈনু ষাট জন

তোমরা চল্লিশ

ভাগের দরে তোমরা আশি

আমরা দশ বিশ

তোমরা দ্যাশের কর্মকর্তা

হামরা চাকর নফর

হামার দ্যাশোর পাট-চামড়া-চা

হামার নাই খবর।

লোকসঙ্গীতের ধর্মীয় প্রভাব, প্রেম-বিরহের প্রভাব প্রবলভাবে থাকে। কিন্তু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপে একটি অঞ্চলের কৃষি গ্রামীণ জীবন যখন নিষ্পেশিত হয় তখন তার সঙ্গীতে প্রেমের বাণী উবে যায়, তার স্থলে পরিচিত লোকসুরটি নতুন বাণীরূপ লাভ করে। এভাবে পূর্ববাংলার মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নেয়ার দাবিতে যখন রাজপথ উত্তাল তখন আলকাপগানের সুরে লোককবি গেয়ে ওঠেন-

আইউব খানের মার্শাল’ল

ইবলিশ বরারব

৫২’র ভাষা আন্দোলন

জিন্নার গায়ে জ্বর।

পূর্ববাংলার প্রাণভ্রোমরা যে বঙ্গবন্ধু তা পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল, তাই তাকে বন্দি করতে না পারলে বাঙালিকে ধ্বংস করা যাবে না। আর তাই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে তারা চক্রান্তের জাল বুনতে শুরু করেছিল, ইয়াহিয়া, টিক্কাখান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো। ভুট্টোই ইয়াহিয়াকে কুমন্ত্রণা দেন বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে বাঙালিদের নির্মমভাবে হত্যা করার। এই ষড়যন্ত্র ও হৃদয়হীন নিষ্ঠুর বর্বর কুচক্রান্তের বর্ণনা পাওয়া যায় একটি জারি গানে।

ইয়াহিয়ার গৃহবাস

ভুট্টা ক্ষেতে করছে সর্বনাশ

ইয়াহিয়া ভুট্টা খাইয়া

করছে এখন হায় হুতাশ।

ভুট্টো যখন ঢাকায় আইল

ইয়াহিয়ারে বুঝাইল

শেখ মুজিবকে বন্দি কর

বাঙালির প্রাণ কর নাশ।

২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু এরেস্ট হওয়া থেকে দেশ স্বাধীন হওয়ার সম্পূর্ণ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে এমন একটি ধুয়াগানে।

‘২৫ মার্চে রাত্রিতে শেখ মুজিবুরকে

এরেস্ট কইরা ধইরা নিল আইয়ুব সরকারে,

বন্দি আমার থাইকা মুজিব ডাইকা বলে বাঙ্গালী

তোমরা একিন দেলে থাক সকলি

ঘরে ঘরে দুর্গ এবার হায় গইড়া তোল সকলে।’

মানিকগঞ্জের বাউল মহিন শাহের লেখা লোকগানে উঠে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অনুপুঙ্খ ইতিহাস। মহিন শাহের জন্ম ১৯০৩ সালে এবং তিনি ১৯৯৬ সালে কুষ্টিয়াতে মűত্যুবরন করেন। গানে গানে আমরা ইতিহাস পাঠের দিকে ধাবিত হই।

স্বাধীনের ইতিকথা বলতে পাই ব্যথা

মনে করো না, নয়নের জল মানা মানবে না।।

ব্রিটিশ বাংলা দুই ভাগ করিল

পূর্ব পাকিস্তান নাম দিল- মরি হায় রে

হলো পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অঙ্গ গো

বাংলাদেশের একতা মোটেই রইল না।।

ছাত্রদল খ্যাপিয়া গেল

তারা জোর প্রতিবাদ জানাতে এলো – মরি হায় রে

সালাম, বরকত, রফিক, শফিক গো

জীবন দিল তবু ফিরল না।।

উনিশশত বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি

শহরে বন্দরে হলো কারফিউ জারি – মরি হায় রে

ভাষা আন্দোলন করলে গুলি হবে গো

বাংলার স্বাধীনতার সেই প্রথম চেতনা।।

এলো আইয়ুব খানের সামরিক শাসন

জেলহাজত করল বিলক্ষন – মরি হায় রে

দাসখতের মুখ বন্ধ হলো গো

বেত্রাঘাতে চামড়া তুলতে ছাড়ল না।।

একাত্তরে মুজিবের নৌকার হলো জয়

রুটিখোরেরা দেখল ভারি বিপর্যয় – মরি হায় রে

দিলো ইয়াহিয়া সৈন্য পাঠাইয়া গো

মার বাঙালি কেউরে ছাড়বে না।।

রাজাকার আর আলবদরের দল

হলো তারা দল ছেড়ে বেদল – মরি হায় রে

সাজিয়া পাকিস্তানের পোষা কুত্তা গো

দেশবাসীকে দিল কতই-না যাতনা।।

পূর্বপরের এসব ইতিহাস

কাহার কাছে করিব প্রকাশ – মরি হায় রে

এখন শেষের পথের যাত্রী মহিন গো

মনের আশা কভু মিটল না।।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এ দেশের বাউল কবিরাও গান গেয়েছেন, গান লিখেছেন দেশের আনাচে কানাচে থেকে। তারা শহুরে জীবনের সাথে তেমনটা সংস্পর্শে না আসলেও দেশ সম্পর্কে তাদের ভাবনা অনেক এগিয়ে। তারা বঙ্গবন্ধুর ডাকে ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় পূর্ব বাংলার জণগনকে সংগ্রামী ও আন্দোলন মূখর করে তোলেন। ১৯৬৬-র ৬ দফার ভিত্তিতে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ সকল সম্প্রদায়ের মানুষ, হিন্দু মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলে একত্রিত হয়ে এক অখ- বাঙালি জাতিতে পরিণত হয়। ৬৯-র গণঅভ্যুত্থানের পর ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। সে সময় নেত্রকোনা জেলার বাউল আবদুল মজিদ তালুকদার গান রচনা করেন।

ঐ দেখরে যায়রে মুজিব

নিশান টাঙ্গাইয়া নাই বাইয়া।।

জিজ্ঞাসা কইরা দেখ তারে

কোন-বা দেশি নাও

মুজিব বাইছে খেলাইয়া নাও

সুরে যায় গান গাইয়া রে।।

নাই নিদ্রা নাই বিশ্রাম

ভাত-পানি না খাইয়া

মুজিব বিনা পয়সায় বেগার খাটে

কোন-বা সুখ পাইয়া রে।।

১৯৭০ -র নির্বাচনের পর আওয়ামীলীগের নৌকা প্রতীক যখন নিরন্কুশ বিজয় লাভ করে, বাউল আবদুল মজিদ তালুকদার গান বাঁধেন।

ছয় দফারই নৌকাখানি

এগারো দফার বৈঠা

গরীব-দুঃখী লইয়া নাও

শূন্যে মারছে উড়া রে।।

ভয় করি না আসুক যত

তুফান কিংবা ঝড়

নায়ের পাছায় বইসা আছে

নেতা শেখ মুজিবুর রে।।

রঙিন কাষ্ঠের রঙ্গিন নাও

রঙ্গিন নায়ের ছইয়া

বঙ্গবন্ধু হাল ধইরাছে

নায়ের পাছায় বইয়া রে।।

শেখ মুজিবের বান্ধা নাও

বান্ধা শক্ত কাঠে

নাওখানি লইয়া মুজিব

চলছে বিশ্বের হাটে রে।।

বাউল কবি আব্দুল মজিদ তালুকদার নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার অন্তর্গত ইডাউতা গ্রামে ১৮৯৮ সনের ১৫ই জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। সে সময়ে আর এক মরমী বাউল কবি জালাল উদ্দিনের এর সহায়তায় নেত্রকোনার রশিদ উদ্দিনের সাথে তার পরিচয় হয়। রশিদ উদ্দিন তার বাউল সাধনায় একাগ্রতা ও তার কণ্ঠ স্বর শুনে মুগ্ধ হয়ে মালজোড়া বাউল গানের তালিম দেওয়া শুরু করলেন। ১৯৩৩ সন হতে তার সংগীত সাধনা একান্তভাবে আরম্ভ হয়। এরপর বাংলা ১৩৪৩ সনে ‘মজিদ সঙ্গীত’ নামে তার প্রথম গানের বই প্রকাশিত হয়। তারপর তিনি বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে স্বরচিত সঙ্গীত পরিবেশন করে অকুণ্ঠ প্রসংশাসহ রচয়িতা হিসেবে সার্টিফিকেট লাভ করেন।

১৯৪৫ সনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয় উৎসব উপলক্ষে গান গেয়ে তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঢাকা বেতার কেন্দ্র কর্তৃক শিল্পী ও সঙ্গীত রচয়িতা হিসেবে গণ্য হন। ১৯৪৫ সনে নেত্রকোনা গাড়ার মাঠে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় কৃষক সম্মেলনে একজন প্রখ্যাত বাউল হিসেবে নীচের গানটি গেয়ে দর্শক শ্রোতাদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টিতে সক্ষম হন। গানটি হলো-

আরে ভারতবাসী কৃষক ভাই

সোনার লাঙ্গল নিমের জোয়াল

চল মাঠে চল হাল বাইতে যাই।

ভাটকবি দারোগ আলী বিখ্যাত পুথি পাঠক, জারীগান গায়ক এবং এক অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা। জন্ম ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে বৃহত্তর ঢাকা জেলার রায়পুরা থানার সাহাপুর গ্রামে। একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ১৯৭২ সালে তিনি রচনা করেছিলেন ‘বঙ্গবিষাদ পুথি’। এই পুথি থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ গ্রন্থিত হলো। পৃথিবীর এ যাবৎকালের সবচেয়ে মুক্তিকামী মানুষকে উন্মাতাল করেছিল অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল মুক্তির অন্বেষার। ১৯৭১ সনের ৭ই মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠে ঘোষণা –

ঢাকায় আসিয়াছিল এহিয়া শয়তান

তার সাথে, দৌলতানা আর কায়ুম খান।।

পরিষদ বাতেল করে করিয়া চালাকি

বঙ্গবাসী বুঝে দেলে সবাই তার ফাঁকি।।

ধীরে ধীরে গুজারিয়া গেল তিন মাস

মাওরাদলের চিন্তা শুধু বাংলার সর্বনাশ ।।

মার্চ মাসের তিন তারিখে সর্দার ইয়াহিয়া

বেতার মারফতে আবার দিল জানাইয়া।।

ছয় দফার দাবী ছাড় শেখ মজিবর

ক্ষমতা বকসিব আমি তোমার উপর।।

প্রধান উজির হও তুমি গদিনশীল হইয়া

ছয় দফা এগার দফা সব দিবা ছাড়িয়া।।

এত শুনি বঙ্গবন্ধু বলে এহিয়ারে

এই সব প্রলাপের কথা না বল আমারে।।

শেখ মজিব বলে শুন্ মাত্তরা হারামজাদা

দেশের জনগনে আমি দিয়াছি ওয়াদা।।

ওয়াদার খেলাপ আমি করিতে না পারিব

দফার দাবী দাওয়া কভু নাহিক ছাড়িব।।

এই রাত শুনি গিধি বাহানা জুড়িল

ফের ঢাকায় আসিবার তারিখ করিল।।

তার সাথে আসতে রাজী হইল ভুট্টো চোরা

বড় কথা বলে কাজের বেলায় থোড়া।

ধুয়া:

বঙ্গবন্ধুর ডাক পড়েছে শুনরে পাতি কান

জয় বাংলা জয় বাংলা বলে উড়াও হে নিশান।।

হেথায় মুজিব মাওরাদলের বাহানা দেখিয়া

রমনার মাঠে বাঙ্গালীদের আনিল ডাকিয়া।।

বজ্রকন্ঠে বঙ্গবন্ধু বলে সবাকারে

শুন যত বঙ্গবাসী বলি তোমাদেরে।।

খানের দলে মোদের সাথে করছে টালবাহানা

জনগনের অধিকার সহজে দিবে না।।

অসহযোগ আন্দোলন কর আজ হইতে

দেখিব ক্ষমতায় কিসে থাকে মাওরাজাতে।।

আমি যাহা বলি তাহা মানিবে তাবৎ

মাওরা গোষ্ঠি তাড়াইতে করহ শপথ।।

খাজনা টেক্স যত আছে কিছু নাহি দিবে

মিলের শ্রমিক কেহ কাজে নাহি যাবে।।

দেশের যত চাকুরীয়া চাকরী ছেড়ে দাও

খানের দলের বিরুদ্ধে সব রুখিয়া দাঁড়াও।।

স্কুল কলেজ যত আছে সব বন্ধ দিয়া

সব মিলে যাও তোমরা সংগ্রাম করিয়া।।

বাংলাদেশে আছে যত শহর গেরাম

এক সমানে চালাও সবে জোরেতে সংগ্রাম।।

এবারের সংগ্রাম জেনো মুক্তির সংগ্রাম।

স্বাধীন করিব এবার বাংলা তামাম।।

আরও বলি শুন সবে রাখিবেক মনে।

আমি যদি নাহি থাকি তোমাদের সনে।।

তবে না ডরিবে কেহ পশ্চিমার ভয়ে ।

হাতের কাছে যাহা পাও দাঁড়াবে তা লয়ে।।

আজ হতে এক সমানে সংগ্রাম চালাও।

জয় বাংলা বলিয়া জাতির নিশান উড়াও।।

এত শুনি শপথ করে ছাত্রনেতাগণ।

নূরে আলম সিদ্দিক আর কুদ্দুছ মাখন।।

জয় ধ্বনী করে সবে যত লোকজন।

জয় বাংলা জয় বাংলা বলে কাঁপবে গগন।।

স্বাধীন বাংলা বলে মজিব করিল ঘোষণা।

আল¬াতালা পুরাইবে মনের বাসনা।।

বঙ্গবাসী এক তালেতে চালাইল সংগ্রাম।

শহর বন্দর বাজার বস্তি গেরাম।।

[১৯৭১ সনের ৭ই মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠে ঘোষণা/ দারোগ আলী]

মূলতঃ বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ ছিল বাঙ্গালীর মুক্তির ডাক। এরকম বলিষ্ট কন্ঠস্বর আর মুক্তিকামী মানুষের জন্য স্বাধীনতার ডাক ও নির্দেশনা বিশ্বের আর কোন নেতার ভাষণে শুনা যায়নি। এদেশের মানুষের বুক ভরে গর্ব করার মতো অনেক কিছুই আছে যা দেখে যা শুনে পৃথিবীর অপর প্রান্তের মানুষও উদ্দেলিত হয় আলোড়িত হয়। ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছে রক্ত দিয়ে জীবন দিয়েছে একমাত্র বাঙ্গালী জাতি। বাঙ্গালি জাতিসত্ত্বার প্রতীক হয়ে উঠেছে ভাষান্দোলনের শহীদ মিনার। আর বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতা শব্দটিরও জন্ম হয়েছে সেই ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ থেকে। এদেশের ভাটকবিরাও সেই সময়ের ইতিহাস তুলে ধরতে ভুল করেনি তাদের রচিত ভাটকবিতায়।

একাত্তুরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রচিত হয়েছিল সংগ্রামী লাচারী গান। যে গান গুলো ভাটকবিতার পর্যায়ভুক্ত। আর এসব লাচারীগানের একজন অন্যতম পুরোধা ছিলেন যামিনী কুমার দেবনাথ। জনসাধারণ্যে তিনি ‘যামিনী সাধু’ নামে পরিচিত। তার প্রকৃত পরিচয় মরমি সঙ্গীত ও সাধক রূপে। তিনি ব্রাহ্মনবাড়ীয়ার সরাইল উপজেলার কালীকচ্ছ গ্রামে ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের ২২ মাঘ জন্মগ্রহণ করেন। পিতা নিদানচন্দ্র দেবনাথ, মাতা জয়কুমারী দেবনাথ। নিজ গ্রামের পাঠশালায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠেই তার শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটে। তার রচিত মরমি গানের সংখ্যা চার হাজারের মতো। তিনি নিচে উলে¬খিত ভাটকবিতাগুলো রচনা করেছিলেন।

জয় বাংলার হত্যাকান্ড কবিতা, পৃষ্ঠা ৮, ১৯৭১

কলির বধুর ব্যবহার প্রথম পর্ব, ১৯৭৩

ঘর জামাই কবিতা পৃষ্ঠা ৮

হায়রে সর্বনাশী বন্যার একাশি, পৃষ্ঠা ৮, ১৯৮৮

১৯৭১ সংগ্রামী লাচারী গান।

মুক্তিযুদ্ধের সময় কবি স্ত্রীপুুত্র নিয়ে ভারতে চলে যান। তিনি সেখানে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বৃদ্ধা মা ও অল্পবয়সী পুত্রকন্যাদের অসহায় অবস্থার কথা ভেবে তিনি লেখনীর মাধ্যমে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার ইচ্ছা করলেন। ১৯৭১ স্বাধীনতা সংগ্রামের সংক্ষিপ্ত ক্ষুদ্র ইতিহাসে কথা ও সংগ্রামী গান শীর্ষক পা-ুলিপিতে কবি যামিনী কুমার দেবনাথ লিখেছেন-

‘জয় বাংলার হত্যাকান্ড আট পűষ্ঠার কবিতা আমি নিজে গানের সুরে গ্রামে গঞ্জে শহরে শহরে প্রচার করিতে লাগিলাম, তার সঙ্গে অনেক সংগ্রামী গানও গাইতে লাগিলাম গানের মাধ্যমে মুক্তি বাহিনীকে অনুপ্রেরণা দিয়ে উৎসাহিত করিতে লাগিলাম। শুধু সংগ্রামী গান আর জয় বাংলা হত্যাকান্ড কবিতা দশ থেকে পনর হাজার কপি হইয়া গেল। পাকিস্তানের বর্বরতা ভারতের ঘরে ঘরে প্রচার করিয়া দিলাম। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট কেনেডি ত্রিপুরা তুলাবাগান শরনার্থী ক্যাম্প পরিদর্শনে আসিয়াছিলেন। তিনিকে নিজ হাতে জয়বাংলা হত্যাকান্ড কবিতা দিয়ে দিলাম। যেন পাকিস্তানীদের অত্যাচার বিশ্ববাসী জানিতে পারে। তখন পাগলের মত সংগ্রামী গান লিখিয়া, নিজ কন্ঠে প্রচার করিতে লাগিলাম। সেই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তুলাবাগান ক্যাম্পে এসেছিলেন, আমি সে বিশাল সভায় কয়েক দফা চেকিংয়ের পর মঞ্চে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে নিজ হাতে জয় বাংলার হত্যাকান্ড কবিতা ও একটি অভিনন্দন কবিতা দিলাম। পাকিস্তানী হানাদারদের চরম অবিচার, অত্যাচার নারী নির্যাতন, গণহত্যা সকলের জানার জন্য। ’

এখানে ‘১৯৭১/সংগ্রামী লাচারী গান’ কবিতাটি উদ্ধৃত করা হলো-

তেরশ সাতাত্তর বাংলা চৈত্রমাসে দিল হামলা

সঙ্গে নিয়ে বারদ গোলা ঢাকার শহরে।

গোলাগুলি করে ঢাকায়, কত লোকে প্রাণ হারায়

টিক্কা খানে মানুষ মারে ইয়ার ছলনায়।

রাত্র দিবা গুলি ছাড়ে, দালান কোঠা চুরমার করে

দুধের শিশু প্রাণে মারে, জঙ্গী সরকারে।।

তাঁতিবাজার গোয়ালনগর, না পাওয়া যায় লোকের খবর

রাত্র হামলা রাজার বাগে পুলিশের উপর।

লালবাগ শাখারীবাজার, ছিন্ন ভিন্ন নাই তাহার

নরনারী করে সংহার, টিক্কার অর্ডারে।।

ঢাকায় যত থানা ছিল, পাঞ্জাবি দখল করিল

গোলা বারুদ বন্দুক সকল, সব নিয়ে গেল।

মেডিকেল কলেজে গেল, বুলেট দিয়া ছাত্র মারল

অবশেষে প্রাণ হারাইল, সকল ডাক্তারে।।

যে সব কান্ড হয় ঢাকাতে, না পারি মুখে বলিতে

লক্ষ লোকে প্রাণ হারাইল, পাঞ্জাবির গুলিতে।

ঢাকার শহর রক্ত¯্রােতে, ভেসে যায় বুড়িগঙ্গাতে

শহরে নাই লোক বলিতে, টুকাইয়া মারে।।

ছাত্র নেতা শিক্ষক মারে, যত ইতি পায় শহরে

খায়ের উদ্দিন মজা করে, হারিকেনের জোরে।

তার বাবা পাঞ্জাবির দলেরে, ঢাকায় যত খবর করে

তালাস করে ঘরে ঘরে, যত বাঙ্গালী মারে।।

রমনা কালীবাড়ী ঢাকায়, চিহ্ন নাহি পাওয়া যায়

মসজিদ মাজার ছিল সেথায়, গুলিতে উড়ায়।

জগন্নাথ কলেজের উপর, চালাইল ট্রেং মর্টার

ইডেন কলেজ করে চুরমার, সব ছাত্রী মারে।।

চিটাগাং কর্ণফুলিতে, তিনটি জাহাজ লঙ্গর করে

মুক্তিফৌজে গুলি ছাড়ে, উঠতে না পারে।

কামান দিয়া গুলি করে, পেট্রোল পাম্পে আগুন ধরে

সকল টাউন পুড়াইয়া মারে, জঙ্গী সরকারে।

শাসক গোষ্টির জারজ সন্তান, ফগা চন্দ্রী নাম ধরে

চিটাগাংয়ের জঙ্গীর দালাল, বানায় ফগারে।

ফগা চন্দ্রী বগার মত, ধ্যানে মগ্ন অবিরত

চিটাগাঙ্গের খবর যত, দেয় তার বাবা চাচারে।।

নরসিংদী ভৈরব বাজারে, বিমান লইয়া ঘুরে ফিরে,

বিমান থেকে গুলি ছাড়ে, কত লোক মরে।

প্রথম বোমা বর্ষণ করে, ব্রাহ্মনবাড়ীয়া শহরে

দ্বিতীয়তে নাপাম বোমায় নরসিংদী পুড়ে।।

বাবা শাহজালাল দরগা ছিল সিলেট সদর টাউনে

ছিন্ন ভিন্ন না রাখিল মেশিনগানে।

কত পীর কামেল ফকিরে, কপালে হাত হায় হায় করে

কত লোকজন প্রাণে মারে, দরগার ভিতরে।।

সিলেট জেলার অন্তর্গত মাধবপুর থানা ধরে

আলোয়াপাড়া গোপালপুর গ্রাম দুই তিনবার পুড়ে।

দালাল গোষ্ঠী লুটপাট করে, রাজাকার মানুষ মারে

যুবা নারী আনে ধরে, কত অত্যাচার করে।

হিন্দু ধর্মের মহাতীর্থ সীতাকুন্ড চন্দ্রনাথ

পাঞ্জাবিরা বোমা ফেলে করলো ধুলিসাত।

যত ধর্মের স্থানে, ধ্বংস করে ইয়া খানে

নিরবিচারে মানুষ মারে, বাঙ্গালী ভাইয়েরে।।

শুন বলি ইয়া সরকার, যত হত্যা কর এবার

জীবন দিয়া আদায় করবো, বাংলার সর্ব অধিকার।

রাজাকারে লুটপাট করে পাঞ্জাবি দেয় পাহারা

ঘরের চালের টিন খুলিয়া নেয় দরজা বেড়া।

ঘরের ভিটির মাটি খুঁড়ে, মুসলিম লীগে ছালা ভরে

ধরে জনে সংহার করে, সুখের সংসারে।

সাহবাজপুরের নুরুল আমিন তোর জন্মের ঠিকানা নাই

কাজে বুঝি গাধার জন্ম, আমি তোমায় বলে যাই।

কি বলিয়া কি করিলে, কত মীরজাফরী করলে

কত ছাত্র শিক্ষক মারলে, বাংলাদেশের ভিতরে

সোনার বাংলা করে শ্মশান, পাকিস্তান জঙ্গী সরকার

কি অপরাধ বাংলার নেতা, ছাত্রছাত্রী শিশুরার।

তোমার দেয়া অধিকারে, শেখ মুজিব ভাই পাশ করে

রাষ্ট্রদ্রোহী কর তারে, নেও পাকিস্তান কারাগারে

সোনার বাংলার নয়নমনি, বঙ্গবন্ধু দেশে নাই

এই সুযোগে সোনার বাংলা পুইড়া করলে ভষ্ম ছাই

জঙ্গী সরকার তোরে জানাই, আর বেশী দিন সময় নাই

আসবে ফিরে শেখ মুজিব ভাই জয় বাংলার ভিতরে।।

ইয়াহিয়া তোরে বলি পাকিস্তান জঙ্গী সরকার

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ছেড়ে দাও, বলি বারে বার।

জান না কি বিষধর সাপ, জানলে করবে বাপরে বাপ

তোর কপালে কি মহাপাপ, জানবে কতদিন পরে।।

ইয়া শয়তান তোরে বলি টিক্কারে যাও বলিয়া

ভূট্টো শয়তান ফাঁদ পাতিল দুই শয়তানের লাগিয়া

একদিন বাংলা স্বাধীন হবে, শেখ মুজিব ভাই বাংলায় আসবে।

পাগল যামিনী কয় যাবো সবে, বাংলা মায়ের উদরে।

[১৯৭১ সংগ্রামী লাচারী গান/ যামিনী কুমার দেবনাথ]

মুক্তিযুদ্ধের ভাটকবিতায় ব্যক্তিগত উপলব্ধির সঙ্গে জাতীয় জীবনের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়ে উঠছে প্রবল ভাবে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াল কালোরাত থেকে বাংলাদেশ জ্বলছে দাউদাউ করে। সমগ্র দেশ যখন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত অত্যাচারের দুঃস্বপ্নে প্রোথিত- গ্রাম বাংলায় ভাটকবিতায় এর স্বরূপ ফুটে উঠে সত্য হিসেবে। ফলে বাংলাদেশের ভাটকবিতায় মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক পংক্তিমালায় দেশ ও সমাজের অঙ্গিকার সোচ্চার হয়েছে জোড়ালো ভাবে সর্বত্র দেশের আনাচে কানাচে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় যে জাতীয়তাবাদী চেতনা, স্বদেশপ্রেম এবং মানবতাবাদী আবেগের স্ফুরন ঘটেছিল তা প্রকাশ করার ক্ষেত্রে লোককবিরা কবিরা সেদিন সোচ্চার ছিলেন। তারা তাদের ভাটকবিতায় অবরুদ্ধ দেশে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে যুদ্ধজয়ের স্বপ্ন আবেগের উচ্চারণ রয়েছে ভাটকবিতায়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল ১৯৭১ সালে সংঘটিত তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের সশস্ত্র সংগ্রাম, যার মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হিসাবে পűথিবীর মানচিত্র আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতের অন্ধকারে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি নিধনে ঝাঁপিয়ে পড়লে একটি জনযুদ্ধের আদলে মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা ঘটে। পঁচিশে মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ঢাকায় অজস্র সাধারণ নাগরিক, ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, পুলিশ হত্যা করে। গ্রেফতার করা হয় ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দল আওয়ামী লীগ প্রধান বাঙ্গালীর তৎকালীন প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। গ্রেফতারের পূর্বে ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের তারিখ নির্ধারণ করেছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। কিন্তু ১ মার্চ বেলা ১টা ৫ মিনিটে আকস্মিকভাবে রেডিওতে ইয়াহিয়া ঘোষণা দেয় যে, ৩ মার্চ অনুষ্টিতব্য জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনিবার্য কারণবশত অনির্দিষ্টকালের জন্য স্হগিত করা হলো। ৭ই মার্চের পর থেকে বিশেষ করে ২৫ মার্চে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কতৃক অপারেশন সার্চলাইট কার্যকর করার মধ্য দিয়ে বাঙালির উপর অমানবিক নির্যাতন, হত্যাকা- সংগঠিত করার পূর্বে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ মুক্তিকামী বাঙালির জীবনে নিয়ে এসেছিল এক অবিনশ্বর সংগ্রামের দ্যোতিময় দিকনির্দেশনা। এই উর্বর ভূমির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই দিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে উদাত্ত কণ্ঠে যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুুর মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,

এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’-

এ দৃপ্ত উচ্চারণে পাকিস্তানের নিষ্পেষণ থেকে বাঙালির মুক্তির মূলমন্ত্র ঘোষণাও করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

৭ মার্চের উত্তাল সেই দিনটিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা ছিল মিছিলের শহর। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষ হেঁটে, বাস-লঞ্চে কিংবা ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়েছিলেন। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষে সয়লাব হয়ে গিয়েছিল বিশাল সেই ময়দান। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে আসা মানুষের ভিড়ে সেদিন রেসকোর্স ময়দান রূপ নিয়েছিল জনসমুদ্রে। সেদিন বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর হাতাকাটা কালো কোট পরে বাঙালির প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু দৃপ্তপায়ে উঠে এলেন মঞ্চে। দাঁড়ালেন মাইকের সামনে। আকাশ-কাঁপানো স্টেনগান আর মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানালেন অপেক্ষমাণ জনসমুদ্রের উদ্দেশে। তারপর শুরু করলেন তার ঐতিহাসিক ভাষণ। কবিতার পঙ্ক্তির উচ্চারণের মতো তিনি বললেন-

তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।

মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব-

এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,

এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

জয় বাংলা।

মাত্র আঠারো মিনিটের এই ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে তুলে আনেন অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায়। এতে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনীর ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন, শহীদদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরসংবলিত চার দফা দাবি উত্থাপন করেন তিনি। রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি প্রচারের সব আয়োজন ছিল ঢাকা বেতার কর্তৃপক্ষের। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ স্বাধীনতার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময় ঘটনা। তার এ ভাষণই সংশয়ে থাকা বাঙালির চোখে জ্বালিয়ে দিয়েছিল স্বপ্নের অমর জ্যোতি। মূলত বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের আহ্বানেই জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পরে ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস গণহত্যার পর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। নয় মাসের যুদ্ধ শেষে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ও জাতির অসাধারণ ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের।

সেই সময়ের প্রেক্ষিতে আবদুল মজিদ তালুকদার লিখেছিলেন এক গান-

মুজিব স্বাধীনতার ডাক দিয়াছে

জাগরে দেশবাসী ভাই

যার যা আছে নিয়ে চল

মুক্তিযুদ্ধে চল যাই।।

শক্ত হাতে অস্ত্র ধর

শত্রুদেরকে কতল কর

নইলে কিন্তু উপায় নাই।।

জাগো কৃষক শ্রমিক ছাত্র জনতা

শেখ মুজিব হয় মোদের নেতা

আমরা আনব স্বাধীনতা

ভয় নাই মোদের ভয় নাই।।

মোরা হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান

সবাই যে এক মায়ের সন্তান

যায় যদি ভাই যাক নারে

সোনার বাংলা স্বাধীন চাই।।

ছলে বলে কলে কৌশলে

অস্ত্র ধর ভাইবোন মিলে

ভেবে কাঙ্গাল মজিদ বলে

নইলে কিন্তু উপায় নাই।।

মহান মুক্তিযুদ্ধের কন্ঠযোদ্ধা ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম ভাওয়াইয়া গানের শিল্পী শাহ আলী সরকার। তিনি অসংখ্য গান গেয়ে মাতিয়ে রেখেছিলেন উত্তাল সময়ের দিনগুলি। তার একটি বিখ্যাত গান এখনো লোকমুখে শোনা যায়-

তোরা কোথায়রে বাংলা ভাষী

মুক্তিযুদ্ধে চলো যাই

আরে ও বাঙ্গালীরে

দুশমনরে দেশে রাইখো না।

তিনি ছাড়াও বিভিন্ন গান পরিবেশন করেছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে। এসব আঞ্চলিক গানই কিন্তু ব্যক্তিমনের উচ্ছাসের ফসল হিসেবে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল যুদ্ধের দিনগুলোতে। এমনই একজন শিল্পী নিরঞ্জন চন্দ্র বর্মন। তার একটি গান এখানে উদ্ধৃত করছি-

কইলে বাহে এইগলা কথা

গর্বে ভরে বুক

বঙ্গবন্ধু আনিয়া দিলে

স্বাধীনতার সুখ ।। (ভাইরে)

৭ই মার্চের ভাষণ শুনি

আকাশে পাতি কান।।

কাহিনিমূলক পুঁথি লোকগান লোকসাহিত্যের একটি বিরাট অংশ। নেত্রকোনা জেলার তরুণ বাউল আবুল বাসার তালুকদার রচনা করেছেন এক অমর কাহিনিকাব্য। ‘মুজিব নামে ডাকি’ শিরোনামের পুঁথি কাব্যে তুলে ধরেছেন বঙ্গবন্ধুর জীবন ইতিহাস ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গ।

প্রভূ নিরাকার নামটি গো তোমায় জপি সর্বদাই

কলম হাতে বসলাম গো আমি কবিতার খাতায়।

লিখব কবিতা  ওহে দাতা, করো কিছু দান

তোমারই দানের পরে পাইব পরিত্রাণ।

পরে লিখে যাই ভাইরে ভাই শুনেন বন্ধুগণ

টুঙ্গিপাড়ার খোকার কথা করিব বর্ণন।

জন্ম তাহার ১৯২০ সালের ১৭ ই মার্চে

চাঁদ যেন নেমে এলো মাটির খুব কাছে।

সে যে মহান নেতা বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা

একাত্তরে তার লাগিয়া পাইলাম স্বাধীনতা।

আইলো ১৯৪৭ সাল  কিবা কাম ভারত দুইভাগ হইল

পাকিস্তানের লগে পূর্ব বাংলা যুক্ত হইয়া গেল।

ভাইরে পশ্চিমা  বেইমানের জাত শোষণ করল শুরু

শেখ মুজিবুর হইতে থাকলেন শোষিতদের গুরু।

শাসনের নামে  শোষণ দিন দিন পূর্ব বাংলার বাড়ে

বিজাতোর উর্দূ ভাষা চাপাইতে চায় ঘাড়ে।

এরই মধ্যে শেখ মুজিব  নতুন রাজনীতি দল গঠন করে

আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম পৌঁছে ঘরে ঘরে।

মোদের মাতৃভাষা বাংলা ধ্বংস করার লাগি

জিন্নাহ সাইবও বোকার মতো করলো ভগিছগি।

রাষ্ট্রভাষার জন্য মুজিব আন্দোলনে নামে

সেই কারণে তারে সরকার জেলে আটক রাখে।

ভাষার লড়াই শুরু হইলে রাজপথ রক্তে ভাসে

শহিদের আত্মদানে মায়ের মর্যাদা আসে।

বাংলা ভাষার  মানমর্যাদা রক্ষা পেলো ভাই

বাঙালি যে একটা জাতি প্রমাণ হইল তাই।

মুজিব বলে  জাগো বাঙালি মুক্তির জন্য জাগো

ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আঁচল পাতো মাগো।

ভাষার জন্য  রক্তের দানে বাঙালি মুক্তির ঐক্য গড়ে তোলে

যুক্তফ্রন্টে বাঙালি সব বিভেদ তাদের ভুলে।

তখন মুসলিম লীগের  পরাজয় ভাইরে চরমভাবে ঘটে

শেখ মুজিব নেতা হচ্ছে সবার কাছে রটে।

এরও অনেক  কারণ আছে ভেবে দেখো ভাই

শেখ মুজিবের কাছে গিয়া নিলো সবাই ঠাঁই।

ফজলুল হক  তখন বয়সের ভাড়ে হায়রে জর্জরিত

মাওলালা আর সোহরাওয়ার্দীর ধারায় আমরা মর্মাহত।

এরই মধ্যে ১৯৫৮ সাল  হইল কাল পূর্ব বাংলার কাছে

আইয়ুব খানের সামরিক শাসন সবার জানা আছে।

শেখ মুজিবুর এমন সময় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে

ছাত্র-যুবক-তরুণ সমাজ মুজিবুরের পিছে ছুটে।

এই না দেখে  আইয়ুব খান নতুন ফন্দি আটে

মিথ্যা মামলায় শেখ মুজিবকে জেলে বন্দি রাখে।

আসে ১৯৬৬ সাল  ভাইরে ৬ দফারই কাল

শেখ মুজিব ধরে তখন স্বাধিকারের হাল।

নানান অভিযোগে  নুজিব জেলে বন্দি থাকে

জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সে সংগ্রামের বাঁকে বাঁকে।

জনতা ক্ষেপে গিয়ে মুক্তি চায় মুজিবের

একেক জন হয়ে ওঠে আলী নামের শের।

এরই মধ্যে ঘটে যায় ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান

যেমন সমুদ্র গর্জন করে ডেকে আনে বান।

শহিদ হয় হায় আসাদ মতিউর আরো কত নাম

মুক্তি পাইলো শেখ মুজিব লেখা আছে রক্তের দাম।

শেখ মুজিব কেবল মুজিব নয় আর

বঙ্গবন্ধু উপাধি পেলো এমন ভাগ্য কার!

এক স্বৈরাচার , এর হইলে আরেক স্বরাচার আসে

ইয়াহিয়া খান নামটি তার সবার চোখে ভাসে।

নিরুপায় হইয়া বেডা নির্বাচনের কথা কয়

৭০-এর নির্বাচন ঠিকেই অনুষ্ঠিত হয়।

৭০-এর নির্বাচনে  বঙ্গবন্ধুর নৌকা বোঝাই ভোটে

৬ দফা আর ১১ দফা লইয়া সারাদেশে ছুটে।

বঙ্গবন্ধুর নৌকা নিয়া  জনগণ সব মাতে

বঙ্গবন্ধু কয় ভাইরে সব ক্ষমতা জনগণের হাতে।

ইয়াহিয়া সংসদের অধিবেশন করে দেয় বাতিল

কাজে আর কথায় ভাইরে নাই যে কোনো মিল।

ও ভাইরে বিশ্বাস না করে তার কথা জনগণে

বঙ্গবন্ধুর ডাকে নামে অসহযোগ আন্দোলনে।

বঙ্গবন্ধুর কথায় তখন চলে দেশের জনগণ

এলোমেলা হয়ে যায় দেশের প্রশাসন।

৭ ই মার্চের ভাষণ দিলেন শেখ মুজিবুর রহমান

বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ সারা বাংলায় বহমান।

সবাই বলে নেতা মোদের শেখ মুজিব শেখ মুজিব

সংগ্রাম থেকে আন্দোলনে সবাই তখন সজীব।

১ লা থেকে ২৫ শে মার্চ উত্তাল ছিল দেশ

সংগ্রামী জনতার মাঝে থাকে আন্দোলনের রেশ।

২৫মার্চ কালরাতে গণহত্যা চালায় নির্বিচারে

ঐ রাতে বঙ্গবন্ধু বন্দি হয় ৩২ নম্বরে।

বঙ্গবন্ধু ২৬ শে মার্চ  স্বাধীনতার ঘোষণা দেন প্রথম প্রহরে

তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ চলে নয় মাস ধরে।

মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে সব পেশারই সব জনতা

বড় অস্ত্র সঙ্গে তাদের বাংলা মায়ের মমতা।

বঙ্গবন্ধু আটক তখন পাকিস্তানের জেলে

জেলখানার পাশে তার কবর খোঁড়া চলে।

বঙ্গবন্ধুর ফাঁসির কাজ  গোপন থাকে না আর

ভারতমাতা ইন্দিরা গান্ধী পাশে দাঁড়ায় তার।

বঙ্গবন্ধুর নামে মুক্তিযুদ্ধ চলে নয় মাস

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর মিটে মনের আশ।

বঙ্গবন্ধু মুক্তি পায় লারকানার জেল থেকে

৭২-এর ১০ই জানুয়ারি ফিরে দেশের বুকে।

ঐতিহাসিক ভাষণ দেয় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা সবাই তাঁকে মানে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

সোনার বাংলা গড়ার কাজে হইলেন স্বপ্নবান।

যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশের জন্য সবার দোয়া চায়

স্বাধীনতার বিরোধী ছাড়া সবাই পাশে দাঁড়ায়।

প্রাইমারি শিক্ষার জাতীয়করণ তাঁর ঐতিহাসিক ঘটনা

শিক্ষার ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন সবার আছে জানা।

হিন্দু-মুসলিম বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবার সমান অধিকার

নিশ্চিত করলো বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ সরকার।

বঙ্গবন্ধু দয়ার সাগর কারো সাথে তার হয় না তুলনা

মনে তার সোনার বাংলা গড়ার বাসনা।

কিন্ত স্বাধীনতার বিরোধীরা তৎপর হয়ে ওঠে

সুযোগ বুঝে ছোবল মারে ৭৫-এর ১৫ ই আগস্টে।

১৫ই আগস্ট হত্যা করে বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবার-পরিজনকে

শিশু রাসেলও রেহায় পায় না তাদের হাত থেকে।

আমার মতো মূর্খ মানুষ রাজনীতির কী আর বুঝি

পরান কান্দে সদাই আমার মুজিব ডাকি ডাকি।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এ দেশের মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তা, বিভীষিকাময় অবরুদ্ধ সময়, সমাসন্ন মৃত্যুর অপেক্ষা, অন্যদিকে মুক্তি ও মৃত্যুর মুখোমুখি সময়, পাক হানাদারের অমানবিক বর্বরতার দৃশ্যাবলি, জ্বালাও পোড়াও, হত্যা ও দমন নীতির রক্তচক্ষু দৃষ্টির বিপক্ষে বাঙ্গালির দামাল ছেলেদের অকুতোভয় সাহসীভাবে পাক হানাদারদের পরাস্ত করে নতুন মানচিত্র, নতুন পতাকা, নতুন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গড়ায় দৃপ্তশপথ এসব বিষয় লোকসংস্কৃতির নানান উপাদানে নিজস্ব স্বকীয়তায় নিজস্ব ঘরানায় তুলে ধরেছেন লোককবিরা, বাউল, গীতালুরা। তা আমাদেরকে সত্যিই বিমুগ্ধ করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের একটি প্রামাণ্য দলিল বলা যেতে পারে। বর্তমানে এসকল লোকসংস্কৃতির এসব অনুষঙ্গ বিলুপ্তির পথে। তাই লোকসংস্কৃতির এসব উপাদানগুলোর সংরক্ষণ জরুরী। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের উপাদানগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তা সংরক্ষণ এবং এ বিষয়ে আরো গবেষণা জরুরী।

তথ্য সহায়ক গ্রন্থ ও পত্রিকা:
১। নেত্রকোণার বাউল কবি, হামিদুর রহমান, আগস্ট ২০১৮, অয়ন প্রকাশন, ঢাকা।
২। লোকসংস্কৃতিতে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ, রঞ্জনা বিশ্বাস, ফেব্রুয়ারি ২০১৭, রোদেলা প্রকাশনী, ঢাকা।
৩। লোকগানে জনকের মুখ, আমিনুর রহমান সুলতান, মার্চ ২০১৯, সাত ভাই চম্পা প্রকাশনী, ঢাকা।
৪। বাউলগানে বঙ্গবন্ধু, সুমনকুমার দাশ, আগস্ট ২০১৭, অন্বেষা প্রকাশন, ঢাকা।
৫। ভাটকবিতায় মুক্তিযুদ্ধ, হাসান ইকবাল, ফেব্রুয়ারি ২০১৬, অয়ন প্রকাশন, ঢাকা।
৬। নেত্রকোণার লোকসংস্কৃতি, হামিদুর রহমান, ফেব্রুয়ারি ২০২০, য়ারোয়া বুক কর্ণার, ঢাকা।

হাসান ইকবাল-কবি। জন্ম ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮০। শৈশব, কৈশোর ও বেড়ে ওঠা নেত্রকোণায়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করেছেন সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে। বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করছেন। কবিতার পাশাপাশি তিনি সমাজভাষা নিয়ে করছেন গবেষণা।
প্রকাশিত বই : নেত্রকোনার প্রবাদ-প্রবচন ও লোকছড়া (প্রবন্ধ), ২০১৪,ভাষা, নারী ও পুরুষপুরাণ (প্রবন্ধ), ২০১৬,ভাটকবিতার মুক্তিযুদ্ধ (প্রবন্ধ), ২০১৬,দেহকাব্যে নারী: বাংলা কবিতায় নারী বন্দনা (প্রবন্ধ), ২০১৯, হুলো, মিনি ও পুষি, (সম্পাদিত শিশুতোষ গল্পগ্রন্থ), ২০১৯, ভাটকবিতার নারী (প্রবন্ধ), ২০১৯,কবিতার শরীর, প্রেম ও অন্যান্য ব্যক্তিগত গদ্য (কাব্যগ্রন্থ), ২০২০।
পুরস্কার ও সম্মাননা
 কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক পুরস্কার ২০১৬
UNESCO Excellent Writer Award 2016
UNICEF Meena Media Award nomination 2019

 

 

 

 

 

 

 

 

Previous Post

কবিতা।। এমরান হাসান

Next Post

কবিতা।। লেবিসন স্কু

Chatal

Chatal

Next Post
কবিতা।। লেবিসন স্কু

কবিতা।। লেবিসন স্কু

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • About
  • Advertise
  • Privacy & Policy
  • Contact
বাংলামটর, ঢাকা-১০০০, বাংলাদেশ।
ই-মেইল: [email protected]

© 2021 Chatalbd - Design & Developed By Developer Rejwan.

No Result
View All Result
  • হোম
  • পরিচিতি
  • প্রবন্ধ
  • কবিতা
  • গল্প
  • সাক্ষাৎকার
  • বই আলোচনা
  • আলোকচিত্র
  • প্রতিবেদন
  • অনুবাদ সাহিত্য
  • বিশেষ আয়োজন
  • বিবিধ
  • কবি-লেখকবৃন্দ

© 2021 Chatalbd - Design & Developed By Developer Rejwan.

Welcome Back!

Login to your account below

Forgotten Password?

Retrieve your password

Please enter your username or email address to reset your password.

Log In