Tuesday, June 24, 2025
  • Login
  • হোম
  • পরিচিতি
  • প্রবন্ধ
  • কবিতা
  • গল্প
  • সাক্ষাৎকার
  • বই আলোচনা
  • আলোকচিত্র
  • প্রতিবেদন
  • অনুবাদ সাহিত্য
  • বিশেষ আয়োজন
  • বিবিধ
  • কবি-লেখকবৃন্দ
No Result
View All Result
  • হোম
  • পরিচিতি
  • প্রবন্ধ
  • কবিতা
  • গল্প
  • সাক্ষাৎকার
  • বই আলোচনা
  • আলোকচিত্র
  • প্রতিবেদন
  • অনুবাদ সাহিত্য
  • বিশেষ আয়োজন
  • বিবিধ
  • কবি-লেখকবৃন্দ
No Result
View All Result
No Result
View All Result
Home প্রবন্ধ

প্রবন্ধ।। কবি রওশন ইজদানী-বিস্মৃতপ্রায় এক নাম ।। স্বপন পাল ।। প্রথম পর্ব

Chatal by Chatal
June 22, 2025
in প্রবন্ধ
A A
0
প্রবন্ধ।। কবি রওশন ইজদানী-বিস্মৃতপ্রায় এক নাম ।। স্বপন পাল ।। প্রথম পর্ব

 ‘সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো বেলা গেল ঐ/কোথায় গেল হাঁসগুলো তৈ তৈ তৈ’-বিখ্যাত এই কবিতার রচয়িতা কবি রওশন ইজদানী সাধারণ্যে তো বটেই আমাদের সাহিত্য পরিমন্ডলেও এখন অনেকটা বিস্মৃত এক নাম। অথচ তিনি ছিলেন বহুপ্রজ কবি। লোকসাহিত্য মূল বিষয় হলেও স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন সাহিত্যের নানা অঙ্গনে। রওশন ইজদানী সৃজনে ও মননে এদেশের লোক-সাহিত্যের ক্ষেত্রে যে গভীর মমতার পরিচয় দিয়েছেন, তা অবিস্মরণীয়।

জন্ম ও বংশ পরিচয়

কবি রওশন ইজদানীর জন্ম লোক সাহিত্যের স্বর্ণভূমি বৃহত্তর ময়মনসিংহের পূর্বাঞ্চলে। ১৩২৪ বঙ্গাব্দের ১৫ই ফাল্গুন (২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯১৭) তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার কেন্দুয়া থানার (বর্তমান নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া উপজেলা) বিদ্যাবল্লভ গ্রামে তাঁর জন্ম। ধর্মপ্রাণতার দিক দিয়ে তাঁর বংশের এক সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ছিল। কবির জন্ম ও বংশ সম্বন্ধে ‘বাংলাদেশ জেলা গেজেটিয়ার: ময়মনসিংহ ১৯৭৮’-এ থেকে জানা যায়ঃ

Poet Raushan Izdani was born at village Bidyaballav under Kendua Police Station in 1917. He belonged to a devout Muslim Family of a Sufi School. The famous Boul Poet, Maulavi Hafez Serajuddin of east Mymensingh was his teacher.

কবি’র এক ডাইরি থেকে এ তথ্য পাওয়া যায় যে, ভঙ্গ মির্দার ও পাতলা মির্দার নামে কবির বংশের দুই আদি পুরুষ দিল্লী থেকে আগমন করেছিলেন। রওশন ইজদানী তাঁদের অধঃস্তন সপ্তম পুরুষ। কবি’র ডাকনাম ছিল ফসু মিয়া।

পরিবার-পরিচিতি

বাংলা লোক সাহিত্যের অসামান্য রূপকার, সংগ্রাহক ও গবেষক এবং সমাজ সেবক কবি রওশন ইয়াজদানীর পিতার নাম শেখ আলী ফকির। পিতৃস্মৃতিচারণে ইজদানী লেখেনঃ

‘১৩৩৩ সনের ১লা ভাদ্র বুধবার আমার পিতৃবিয়োগ ঘটে। আমার বরস তখন প্রায় দশ বছর। আমার পিতা ছিলেন ফকির। তিনি কবিরাজী জানতেন।’

ইয়াজদানী পরিবারের কিছু স্থাবর ভূসম্পত্তিও ছিলো। কবিকৃত স্থাবর সম্পত্তির এক তালিকায় দেখা যায়, বিদ্যাবল্লভ মৌজায় তাঁদের ভূসম্পত্তির মোট পরিমাণ ছিলো দুই একর ১৫ শতাংশ। আধি বর্গায় এই জমি চাষাবাদ ছিলো ইজদানী পরিবারের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস।

রওশন ইয়াজদানী ছিলেন পিতার একমাত্র পুত্র সন্তান এবং সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে ছিলেন চতুর্থ। তিন বোন ছিলেন তাঁর বড়। এর মধ্যে বড় দুই বোন ছিলেন অত্যন্ত মেধা শক্তির অধিকারিণী এবং তৎকালীন ছাত্র বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ও সরকারি পুরস্কার প্রাপ্ত। কবির পিতা ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। তিনি মুন্সী-মৌলবী ও পীর-ফকিরদের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। নিজেও ফকিরালী করতেন। কবির এক চাচা মোহাম্মদ হায়দর আলী ছিলেন একজন গুণী আলেম। তিনি কলকাতায় থাকতেন।

মুন্সীগঞ্জ থেকে প্রকাশিত ‘গ্রামের কথা’ নামক পত্রিকায় এম. ইয়াসিন রচিত ‘কবি রওশন ইজদানী’ শীর্ষক নিবন্ধ থেকে জানা যায়:

‘কবির মাতা মরহুমা বেগম আতাফুন্নিসা ছিলেন একজন মিষ্টভাষিণী, সরলা ও ধর্ম পরায়ণা গ্রাম্য মহিলা। আরবী ভাষায় তাঁহার মোটামুটি ভালো জ্ঞান ছিল। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, কবির পূর্ব পুরুষগণের ধর্মীয় শিক্ষার যে ঐতিহ্য রহিয়াছে তাঁহার মাতৃকুলও সেই ঐতিহ্যের অধিকারী ছিলেন। তাঁহার মাতামহ মরহুম লাবু মুন্সী স্থানীয় এলাকার একজন বিশিষ্ট মুনশী ও মোল্লা ছিলেন। তিনি পাঁচ গ্রামের ফতোয়া দিতেন। … কবির মামাদের মধ্যেও দুইজন ছিলেন মুনশী এবং তাঁহারা ইমামতিও করিতেন। … কবির মাতৃভক্তি আদর্শ স্থানীয়। মাতার জীবদ্দশায় কবি তাঁহাকে ছাড়িয়া দীর্ঘদিনের জন্য কোথাও গমন করেন নাই; কারণ, বিদেশ যাত্রার প্রতি মাতার একান্ত কঠোর নিষেধ ছিল।’

বেগম আতাফুন্নিসা ১৩৪৩ সনের ১৪ চৈত্র, রবিবার ( ইং ২৮ মার্চ, ১৯৩৭) মৃত্যুবরণ করেন বলে রওশন ইজদানীর ডায়েরি থেকে জানা যায়।

কবি’র ঘনিষ্ঠ সুহৃদ ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার ঝাটিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক আবু ফাতেমা মুহাম্মদ ইসহাক রচিত ‘পল্লীকবি রওশন ইজদানী’ গ্রন্থের পান্ডুলিপিতে উল্লেখ আছে,

‘‘ধর্মপ্রাণতা ছিল কবি পরিবারের বৈশিষ্ট্য এবং বহু আলেম ফাজেলের জন্ম হয়েছে কবির বংশে। তাঁর দাদা দাদীমা, ফুপু আম্মারাও ধর্মীয় জীবনযাপন করতেন। তাঁর এক ফুপুর স্মৃতিশক্তি এতই প্রখর ছিল যে, ‘জংনামা’, ‘আমির হামজা’র মতো বিরাট বিরাট পুঁথি অনায়াসে আগাগোড়া কণ্ঠস্থ রাখতে পারতেন।’’

শিক্ষা-জীবন

‘নিজের অজ্ঞতাকে উপলব্ধি করার ক্ষমতাই জ্ঞানীর পরিচায়ক’

রওশন ইজদানীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি ছিলো না। গ্রামের মক্তবে তাঁর হাতে খড়ি। এরপর ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন; কিছুদিন ওল্ড স্কীম মাদ্রাসায় শিক্ষা লাভ করেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই স্থিরতা ছিলো না তাঁর। প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য দুইবার স্থানীয় আশুজিয়া হাইস্কুলে ভর্তি হন, কিন্তু পরীক্ষা আর দেওয়া হয় নি। বাউল ও পল্লীগীতির প্রতি একান্ত অনুরক্ত ছিলেন তিনি এবং বাল্যকাল থেকেই সঙ্গীতের চর্চা করতেন। জানা যায়, বাউল গানের আসরে যোগদান করার কারণেই প্রবেশিকা পরীক্ষা দেয়া হয়নি তাঁর। নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতার ব্যাপারে ইজদানীর ইংরেজীতে লেখা একটি নোট ছিল এমনঃ I have read up to class x (ten) privately in 1937.

কবির শিক্ষা জীবন সম্পর্কে আবু ফাতেমা মুহাম্মদ ইসহাক রচিত ‘পল্লী কবি রওশন ইজদানী’ গ্রন্থের পান্ডুলিপিতে কিছুটা বিস্তৃত বিবরণ যাওয়া যায়ঃ

‘তাঁর বংশের ঐতিহ্য মাফিক তিনি প্রথমে গ্রামের মক্তবে শিক্ষালাভ করেন। বুাংলা ১৩৩৩ সনের ১লা ভাদ্র তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। পিতার মৃত্যুর পর তাঁর মা ছাড়া অন্য কোনো লোক তাঁর সংসারের অভিভাবক ছিলেন না। সে জন্য দূরে যেয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ তাঁর হয়ে উঠে নি। তিনি মক্তবের পাঠ গ্রহণ সমাপ্ত করে গ্রামের এক ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় যেয়ে ভর্তি হন এবং কিছুকাল কোরআন শরীফ পাঠে মনোযোগী হন। কোরআন শরীফ হেফজ করা শুরু করেন। ফোরকানিয়া মাদ্রাসাটি কিছুকাল পর ভেঙ্গে যাওয়ায় তাঁর কোরআন মজীদ হেফজ করা শেষ হতে পারেনি। অতঃপর তিনি এক ওল্ড স্কীম মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং কিছুকাল সেখানে পড়াশুনা করেন। সেখান থেকে তিনি চলে যান আশুজিয়া হাই স্কুলে শিক্ষাগ্রহণ করতে। ধরা-বাঁধা কোনো শিক্ষার প্রতি তাঁর আকর্ষণ তেমন ছিল না। তবে নানা বিষয়ে জ্ঞান লাভের আগ্রহ ছিল প্রবল। তাঁর শিক্ষণীয় বিষয় সুনির্দিষ্ট না থাকায় তিনি কখনোও আরবী ফারসী পাঠে মনোযোগী হতেন, কখনোওবা বাংলা ইংরেজী পড়তে আগ্রহী হতেন। তবে কোনোটাতেই দীর্ঘদিন আগ্রহী থাকতেন না। কখনো এটা কখনো সেটা ইত্যাদিতে রত হতেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত শিক্ষা পদ্ধতি তাঁর খুব একটা ভালো লাগতো না। তাই বন্ধু-বান্ধবের চাপে পড়ে দু’ দুবার প্রবেশিকা পরীক্ষা দেবার জন্য প্রস্তুতি নিয়েও পরীক্ষা আর দেননি। যখন যেদিকে তাঁর ঝোঁক চাপত, কিছুকাল নির্বিঘ্নে সেদিকেই অধ্যয়নরত থাকতেন।’

তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় আগ্রহ না থাকলেও পড়াশোনার প্রতি ছিল প্রচন্ড ঝোঁক ছিল তাঁর। কবির অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু ‘মদীনা’ পত্রিকার সম্পাদক মওলানা মহীউদ্দিন খান বলেনঃ

‘প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি না থাকলেও ইজদানী প্রচুর পড়াশুনা করতেন। কোনও তথ্য ভালোভাবে না জেনে এবং যাচাই না করে তিনি গ্রহণ করতেন না। ঢাকায় থাকতে ডঃ শহীদুল্লাহ্’র সাথে তাঁর হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল। ডঃ শহীদুল্লাহ্’র বেগম বাজারস্থ বাসার পারিবারিক গ্রন্থাগারের দরোজা রওশন ইজদানীর জন্য সর্বদা উন্মুক্ত ছিল। পাটুয়াটুলিতে অবস্থিত রামমোহন লাইব্রেরীতেও তিনি নিয়মিত যাতায়াত করতেন। এ ছাড়া, বিভিন্ন সুধীব্যক্তির সংস্পর্শও তাঁকে করেছিল আলোকিত।’

রওশন ইজদানীর কবিতার খাতা;-যা একই সঙ্গে তাঁর দিনপঞ্জী হিসেবেও ব্যবহৃত; তা থেকে তাঁকে আজীবন শিক্ষার্থী হিসেবে আবিষ্কার করা যায়। অবিরাম লেখা ও সেই সাথে পড়া, এই ছিলো তাঁর জীবনের সর্বক্ষণের কাজ। সাংসারিক বিষয়ে মোটেও মনোযোগী ছিলেন না ইজদানী। কিন্তু যখনই যা কিছু পড়তেন, তার সার সংক্ষেপ খাতায় টুকে রাখতে ভুলতেন না। মনীষীদের সারগর্ভ বাণীও তাঁর খাতার বিভিন্ন স্থানে লিখা আছে। তাঁর একটি লেখার খাতায় তাঁর স্বাক্ষরযুক্ত একটি মন্তব্য ছিল এমন: ‘নিজের অজ্ঞতাকে উপলব্ধি করার ক্ষমতাই জ্ঞানীর পরিচায়ক-রওশন ইজদানী’।

জানা যায়, তাঁর গ্রামের বাড়িতে একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরী ছিল। এটি তাঁর জ্ঞান সাধনার সাক্ষ্য বহন করে। লাইব্রেরীটি এখন কি অবস্থায় আছে জানা নেই। শত বছর পূর্বে বিদ্যাবল্লভের মতো নিভৃত পল্লীতে বসে তাঁর এই জ্ঞান সাধনা ছিলো সত্যিই বিস্ময়কর। ইয়াজদানীর সুন্দর বাংলা ও ইংরেজী হস্তাক্ষরে যে পাকা মুসীয়ানার ছাপ ফুটে ওঠতে দেখা যায়, তা তাঁর ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়েরই ফল। তাঁর বাংলা গদ্য লেখাতেও মেলে সুসংহত মননচর্চা ও বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়।

শুধু নিজে নিজে শিক্ষা গ্রহণ নয়, শিক্ষাবিস্তারেও ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ। রওশন ইজদানী বোধ হয় সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন তাঁর নিজের গ্রামকে। সেই জন্য কাছাকাছি স্কুল থাকতেও নিজ গ্রামে আরো একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাঁকে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে দেখা গিয়েছে ।

সংসার-জীবন

কবি ইজদানী তাঁর স্মৃতিকথামূলক রচনা ‘জিন্দেগানীর হালখাতা’-তে লেখেনঃ

‘পিতার ইন্তিকালের পর আমার সংসারে এক মা ছাড়া কেউ ছিল না । ছোট সংসার…একান্ত ছোট্ট খরচেই চলে যেতো। সপ্তাহে চার দিন বাজার করতাম মাছ তরকারীর জন্য। বাজার করার মত নগদ পয়সা কড়ি হাতে থাকতো না। আমি এক খুচি (পৌণে দু’সের) চাউল বাজারে নিয়ে এক আনা, পাঁচ পয়সা বা বেশী চড়তি দরের সময়ে ছ’পয়সা বিক্রয় করতাম। পরে এক পয়সার পান, দু পয়সার সুপারী, এক থেকে তিন পয়সার ছোট্ট মাছ ও এক পয়সার তরিতরকারী আনতাম। এতেই আমার যথেষ্ট হতো।’

এ-বিবরণ থেকে সহজেই বোঝা যায় কবির সংসারে বিত্ত না থাকুক, চিত্ত ছিল। কিন্তু এ অবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। তিনি ছিলেন পিতামাতার একমাত্র পুত্র সন্তান। দূরসম্পর্কীয় ছাড়া নিজের আপন চাচা বলতেও কেউ ছিলেন না। তাই একমাত্র অভিভাবক মা’র মৃত্যুতে তাঁর জীবনের স্বস্তিটুকুও চলে যায়। তখন কবি’র বয়স উনিশ।  তাঁর মনে গভীর বৈরাগ্য দেখা দেয়। এ সম্বন্ধে বিশিষ্ট বন্ধু আবু ফাতেমা মুহাম্মদ ইসহাকের কথা থেকে থেকে জানা যায় :

‘তাঁর মায়ের মৃত্যুতে সংসারের প্রতি তিনি একরূপ উদাসীন হয়ে পড়েন। তিনি আউল-বাউলদের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। বাউলদের আসরে তিনি যোগ দিতে শুরু করেন। এ ভাবেই চলে তাঁর জীবন বেশ কিছু কাল।’

কবি রওশন ইজদানীর এ সময়ের অবস্থা সম্পর্কে তাঁর ভাগ্নে বিদ্যাবল্লভ গ্রাম থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত সান্দিকোণা উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বলেন:

‘মাতৃ বিয়োগের পর তিনি উদাসীন হয়ে বাউলদের সাথে মিশতে শুরু করেন। এ সময় বিবাগী অবস্থায় কবি এসরাজ বাজিয়ে গান করতেন। পরে তাঁর ভগ্নিপতির কথায় ধীরে ধীরে এ পথ থেকে সরে আসেন এবং সুস্থ হয়ে কিছুদিন পর বিয়ে করেন। কবির নিজের পছন্দমতো এ বিয়ে হয়। কিন্তু পরবর্তীতে কবিপত্নী কবির কাব্যসৃষ্টির যথোচিত মর্যাদা দিতে ব্যর্থ হন। এজন্য তাঁদের দাম্পত্য জীবন সবসময় স্বস্তিজনক ছিল না।’

রওশন ইজদানীর ‘কবি ও গিন্নির ঝগড়া’ নামে একটি কবিতায় এই মন্তব্যের যথার্থতা প্রমাণিত হয়। ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত শেখ আলেফুদ্দীন শ্রীপুরী সম্পাদিত ‘শিক্ষক সুহৃদ’-এ কবিতাটি মুদ্রিত হয়েছিলো। এছাড়া, কবির মৃত্যুর পর আঠারোবাড়ি হাইস্কুলে তাঁর স্মরণে অনুষ্ঠিত সভায় তাঁর অন্যান্য রচনার মধ্যে এই কবিতাটিও অভিনীত হয়।

কবিপত্নী জুবায়দা আখতার খাতুন ছিলেন কবি’র নিজ গ্রাম থেকে দুই মাইল দূরে অবস্থিত ওয়াই গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাংলা ১৩৪৬ সালে রওশন ইজদানীর সাথে তাঁর বিয়ে হয়। সুকণ্ঠের অধিকারিণী ছিলেন তিনি। জানা যায়, আবাসউদ্দীন তাঁর গান রেকর্ডের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কবি পরিবারের রক্ষণশীলতার জন্য তা সম্ভব হয় নি।

রওশন-জুবায়দা দম্পতি পাঁচ পুত্র ও দুই কন্যা অর্থাৎ সাত সন্তানের জনক-জননী ছিলেন। সাত সন্তানের মধ্যে চারজন প্রয়াত হন জন্মের সাড়ে তিন মাসের মধ্যেই। তারা হলেন; প্রথম সন্তান আবুল কালাম আব্দুহু (জন্মের পর আড়াই মাস জীবিত ছিলেন), দ্বিতীয় সন্তান ফজলে রাব্বানী (আয়ুস্কাল ছিলো সাড়ে তিন মাস), চতুর্থ সনÍান গোলাম জাফর হাসান (জন্মের পর বেঁচেছিল ৩৪ দিন) এবং পঞ্চম আমিনা খাতুন (১৩ দিন জীবিত ছিলেন)।

তৃতীয় সন্তান গোলাম হায়দার জুলফিকার ইজদানী (ভুট্টো), ষষ্ঠ সন্তান গোলাম জাফর ইজদানী সাদেক এবং সপ্তম সন্তান সুরাইয়া বেগম এবং স্ত্রী জুবায়দা আখতার খাতুনকে রেখে ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন, ১৩৭৪ বঙ্গাব্দের ৫ আষাঢ় কবি রওশন ইজদানী প্রয়াত হন। ছেলে জুলফিকার ম্যাট্রিক পাশ করে শিক্ষকতা করেছেন এবং জাফর সাদেক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এ চাকুরি করেছেন। মেয়ে সুরাইয়া বেগমের বিয়ে হয়েছে দীঘলী গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মান্নানের সাথে। সন্তানদের মধ্যে বর্তমানে শুধু সুরাইয়া বেগমই জীবিত আছেন।

স্ত্রী জুবায়দা আখতার খাতুন আনুমানিক ৬০/৬৫ বছর বয়সে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রয়াত হন।

কবি’র মৃত্যুর পর কবি পরিবারে চরম দারিদ্র নেমে আসে। জীবদ্দশায় কবি নিজেও ছিলেন দারিদ্র-পীড়িত। তাই তেমন কিছু সহায় সম্বল রেখে যেতে পারেন নি। ভিটেমাটি সহ দেড় একর পরিমাণ আবাদী জমি ও দু’টি টিনের ঘর রেখে যান। জীবিত থাকাকালে কবি সরকার থেকে মাসিক ১৫০.০০ টাকা সাহিত্য ভাতা পেতেন। মৃত্যুর পর আড়াই বছর অনেক চেষ্টা তদ্বিরের মাধ্যমে এই ভাতা তাঁর স্ত্রীর নামে বরাদ্দ করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ভাতার পরিমাণ ৩৫০.০০ টাকায় উন্নীত করা হয়। এছাড়া, সরকার থেকে কবির সন্তানাদির জন্য এককালীন তিন হাজার টাকা দেওয়া হয়।

জীবন-জীবিকা

মাসিক ‘দিলরুবা’র ১৩৫৯ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন-চৈত্র সংখ্যার প্রকাশিত ‘নজরুল সাক্ষাৎকারে’ প্রবন্ধে ইজদানীর ১৩৪২ সনে কলকাতা যাওয়ার বিষয় জানা যায়। এর এক বছর পর তাঁর মার মৃত্যু হয়। মা’র মৃত্যুতে কিছুদিনের জন্য তাঁর সংসার বৈরাগ্যের কথা আগেই বলা হয়েছে। এ-সময় তাঁর কোথাও চাকুরিরত না থাকাই স্বাভাবিক। বিয়ের পর গৃহী জীবন শুরু হলে ইজদানী কর্ম সংস্থানের চেষ্টা করেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর বন্ধু আবু ফাতেমা মুহম্মদ ইসহাক বলেন:

‘বিবাহিত জীবনে তাঁর কিছুটা সংসারের প্রতি আকর্ষণ আসে। খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য তিনি চাকুরির সন্ধানে রত হন। গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকতায় যোগদান করেন। কিন্তু তাতে না আসে পয়সা, না আসে ভাতা। স্কুলের চাকুরি তিনি ছেড়ে দেন। গৃহস্থি কার্যেও মন বসে না, গৃহস্থির কাজ করতে জানেন না বা পারেনও না। এসময় ঋণ সালিশী বোর্ডের কেরানীর চাকুরিতে যোগ দেন তিনি। সেখানে তিনি ইং ১৯৩৭ সন থেকে ১৯৪১ সন পর্যন্ত চাকুরি করেন।’

এরপর ১৯৪২ থেকে ১৯৪৮ পর্যন্ত ইজদানীর কর্মজীবন গ্রামেই কাটে। তাঁর নিয়মিত সাহিত্যিক জীবনেরও সূত্রপাত এই সময়েই। আগেই অবশ্য এর উন্মেষ পর্ব সূচিত হয়েছিলো। জীবনের প্রথম পর্যায় থেকে গ্রামে প্রচলিত গীতিগানের প্রতি একটা আকর্ষণ দেখা দেয় তাঁর। কবিগান ও গাইনের গীতের আসরে যেতে যেতে গ্রাম্যগীতি রচনার প্রতি তাঁর একটা ঝোঁক এসে যায়। তিনি লিখতে শুরু করেন। শুরু হয় তাঁর সাহিত্য চর্চা। মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের নেত্রকোণা শাখার অধীনে গরাডোবা ইউনিয়নে তাঁর নিয়োগ, গ্রামের সালিশ দরবার পরিচালনা প্রভৃতি এই সময় তাঁর গ্রামকেন্দ্রিক কর্মজীবনের অন্তর্গত ছিলদ বলে জানা যায়।

অতঃপর তাঁর কর্মজীবনে মোড় পরিবর্তন ঘটে। আগে থেকেই তিনি লিখছিলেন- দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপাও হচ্ছিলো। এ পর্যায়ে এসে তিনি ঢাকার দিকে পা বাড়ালেন। মাত্র দেশ বিভাগ হয়েছে। ঢাকা তখন সদ্য নতুন প্রাদেশিক রাজধানী। রওশন ইজদানী দৈনিক আজাদে চাকরি নিলেন।

এ-সম্বন্ধে ইজদানীর নিজের স্মৃতিচারণ:

‘আমি আজাদ পত্রিকার সাক্ষাৎ সম্পর্কে আসি ১৯৪৮ সালের শেষাশেষি। কলকাতা থাকাকালে আজাদে ক্বচিৎ দু’একটি লেখা পাঠাতাম—হয়তো কোন কোনটি প্রকাশিত হত-মুকুলের মহফিলেও হত দু’একটা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সেদিন আজাদই ছিল বাঙ্গালী মুসলমানের একমাত্র দৈনিক মুখপত্র। দূর গ্রামাঞ্চলে বাস করেও জানতাম আজাদকে কেন্দ্র করে—বিশেষ করে এর সাথে যাঁরা সংশ্লিষ্ট তাঁদের নেতৃত্বে ও প্রচেষ্টায় সাহিত্য ক্ষেত্রেও একটি নতুন চেতনা রূপ লাভ করছে। এতদ্দরুণ আজাদের প্রতি আমার বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম। ঢাকায় আজাদের নবনির্মিত ঘরে তখন সবেমাত্র কাজ শুরু হয়েছে। চাকুরি করার বাসনা নিয়ে জনাব শামসুদ্দীন ও জনাব মুজিবর রহমান সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। উভয়েই আশ্বাস দিলেন। অতঃপর ১৯৪৮ সালের শেষাশেষি আজাদের বার্তা বিভাগে নিযুক্ত হলাম। আমি কখনও পারত পক্ষে অতিরিক্ত বা ডবল ডিউটি করে অতিরিক্ত রোজগারের প্রয়াস পেতাম না।’

তিনি আরও লেখেন :

‘আজাদে যে উদ্দেশ্যে চাকুরি গ্রহণ করেছিলাম তা আমার পুরোপুরি সফল হয়েছিল। সে উদ্দেশ্য ছিল নিছক সাহিত্য সংক্রান্ত, শিক্ষা-সংক্রান্ত-সাংবাদিকতার প্রশ্ন ছিল আমার কাছে গৌণ এবং তা ছিল নিছক চাকুরির কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের জন্য।’

রওশন ইজদানী আজাদে ছিলেন দীর্ঘ সাত বৎসর। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে পত্রিকাটির আর্থিক সমস্যা দেখা দেয় এবং ব্যয় সংকোচন অনিবার্য হয়ে ওঠায় ইজদানীকে আজাদের চাকুরি থেকে অবসর দেওয়া হয়।

দৈনিক আজাদের পর ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরের পূর্ব পর্যন্ত রওশন ইজদানী আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো কাজে যুক্ত ছিলেন না। এই সময় জীবিকার জন্য তাঁকে সম্পূর্ণ লেখার ওপর, বিশেষ করে স্কুলের পাঠ্যবই প্রণয়নের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। ঢাকা মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের তৎকালীন সেক্রেটারী জনাব আবদুল সামাদ ছিলেন তাঁর অন্যতম শুভাকাংক্ষী। তিনি ইজদানীকে পাঠ্য বই প্রণয়নের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। সাহিত্য-কর্মের পাশাপাশি ইজদানী বিভিন্ন শ্রেণীর উপযোগী অনেকগুলো স্কুলপাঠ্য পুস্তকও লিখেছিলেন। দ্রæত পঠনসহ তাঁর এ-ধরনের বইয়ের সংখ্যা ছিল মোট ১৭টি।

ছত্রিশ বছরের সৃষ্টিশীল সাহিত্য-জীবন

Poetry and literature are his main occupations in lif-রওশন ইজদানীর সাহিত্য-জীবন সম্পর্কে  আলোচনায় এই মন্তব্যটির যথার্থতা অনস্বীকার্য। তাঁর কর্মজীবনের আলোচনায় দেখা গেছে, জীবন-জীবিকার বিষয়টি তাঁর কাছে মুখ্য ব্যাপার ছিলো না, বরং বলা চলে এটি ছিল তাঁর সাহিত্যিক জীবনেরই সম্পূরক মাত্র।

“তিনি ভালো ফার্সী জানতেন। শেখ সাদীর একটি বয়েত আছে- যেখানে কলম বলছে: ‘যে আমাকে দৃঢ় হস্তে ধারণ করবে, আমি তাকে বাদশাহী দরোজার পৌঁছে দেব।’ রওশন ইজাদানী কলমের সাথে এই ওয়াদা করে তাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন-আমৃত্যু তাকে ছাড়েননি।” রওশন ইজদানী’র জীবন চর্চা ও চর্যা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে কবিপুত্রের এমন মন্তব্যের যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যাবে।

তিরিশের দশক থেকে ষাট দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত পরিব্যপ্ত ছিলো তাঁর ছত্রিশ বছরের সৃষ্টিশীল সাহিত্য-জীবন। এ সময়ের মধ্যে তিনি রচনা করেছেন পল্লীগীতি, কিস্সা-কাহিনী, গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা, জীবনী, গাঁথাকাব্য-গ্রামে গ্রামে ঘুরে সংগ্রহ করেছেন লোকসাহিত্য-সেগুলি নিয়ে গবেষণা করেছেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাঁর এই সাহিত্য প্রয়াস অব্যাহত ছিলো। আর এ-ব্যাপারে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কর্তব্যনিষ্ঠ, যদিও দৈনন্দিন সংসার জীবনে তাঁর উদাসীনতা নিয়ে অনেক কথাই শোনা যায়। তাঁর প্রতিটি রচনারই তিনি হিসাব রেখেছেন। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর প্রকাশিত-অপ্রকাশিত সমস্ত রচনা-বই-পত্রাদি দু’টি আলমারীতে গুছিয়ে রেখেছিলেন বলে জানা যায়।

রওশন ইজদানীর সাহিত্য-জীবনের পর্যালোচনায় তিনটি স্তর চোখে পড়েঃ

এক; কিশোর বয়সে পল্লীগিতি, কিস্সা-কাহিনী, সারি, জারী প্রভৃতি রচনার স্তর; মাসিক ‘দিলরুবা’য় প্রকাশিত তাঁর ‘নজরুল সাক্ষাৎকারে’ শীর্ষক প্রবন্ধের এক জায়গায় তিনি লিখেছিলেন, ‘এ সময় আমি কবিতা লিখতাম কম। পল্লীর ছড়া, গান, পালা ইত্যাদিতে আমার ঝোঁক ছিল বেশী’।

দুই; নজরুলের রীতিতে আধুনিক কবিতা রচনার স্তর ; (কলকাতায় কাজী নজরুল ইসলামের সাথে সাক্ষাৎ ছিলো তাঁর কৈশোর সাহিত্য জীবনের একটি প্রধান ঘটনা। নজরুল কর্তৃক প্রভাবান্বিত হয়ে প্রথমে তিনি যে কবিতাটি লিখেছিলেন, সেটির নাম ছিলো ‘ফজলুল হক’। নজরুলের ঢংএ লিখিত কবিতাসমূহ কবি পরে পুস্তকাকারে প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর ‘বজ্রবাণী’ ও ‘রাহগীর’ ছিল এই স্তরের কাব্যপ্রয়াস)।

তিন; সচেতনভাবে লোকসাহিত্য সংগ্রহ, গবেষণা ও রচনার স্তর;

বলাবাহুল্য, শেষোক্ত স্তরই ছিলো তাঁর আসল কর্মের জগত। লোক সাহিত্যের স্বর্ণময় অঞ্চল পূর্ব ময়মনসিংহে-তথা নেত্রকোণায় তাঁর জন্ম ও বিকাশ। তিনি ছিলেন এই অঞ্চলের মানসপুত্র। তাঁর ‘বন্ধের বাণী’ থেকে ‘খাতামুন নবীঈন’ পর্যন্ত শেষোক্ত স্তরের পূর্ণ রসপ্রবাহ দীপ্যমান। পূর্বের দুই স্তর ছিলো তাঁর প্রস্তুতি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর্ব। জানা যায়, ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’-র সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে (১৮৮৯-১৯৪৭) তাঁকে বাউল গীতি রচনার স্তর থেকে লোকসাহিত্যের দিকে প্রথম আকৃষ্ট করেন। চন্দ্রকুমার দে ছিলেন তাঁর নিকট প্রতিবেশী। তাঁর বিদ্যাবল্লভ গ্রাম থেকে ছয় মাইল দূরে আইথর গ্রামে ছিলো চন্দ্রকুমারের বাড়ি। আরেক লোকসাহিত্যপ্রেমী সিরাজউদ্দীন কাশেমপুরীও তাঁকে পরিণত বয়েসে এদিকে অনুপ্রাণিত করেন। পাকিস্তান-উত্তর কালে কবি ফররুখ আহমদও তাঁর প্রতিভার বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করে ইজদানীকে পল্লীসাহিত্যের জগতে থেকেই সাহিত্য রচনার পরামর্শ দেন। এসব প্রেরণা তাঁর জীবনে অনুকূল প্রভাব ফেলেছিল। এর সাথে মিশেছিল পূর্ব ময়মনসিংহ অঞ্চলের স্বাভাবিক সৃজনশীল জীবন ঘনিষ্ঠ লোকমানস।

পূর্ব ময়মনসিংহ বলতে সাধারণতঃ ময়মনসিংহ জেলার পূর্বাঞ্চল তথা নেত্রকোণার সমগ্র এলাকা, কিশোরগঞ্জের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এবং ময়মনসিংহের আরও কতিপয় এলাকাকেই বুঝায়। পূর্ব ময়মনসিংহও বাংলাদেশের অন্যান্য অংশের মত নদী বহুল। কংশ, ধনু, মগড়া, সোমেশ্বরী, উব্দাখালি প্রভৃতি নদী বয়ে চলেছে ময়মনসিংহ জেলায় পূর্বাঞ্চলের ভেতর দিয়ে। এগুলো লোকসাহিত্যের উৎস হিসেবেই বহমান। এ পরিবেশ থেকে জন্ম নিয়েছে নানা প্রকারের ছড়া, গাঁথা, রূপকথা, ধাঁধাঁসহ লোকসাহিত্যের অমর সব সম্পদ।

পূর্ব ময়মনসিংহের ভাটি অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ভাটিয়ালী গান, জারী, সারি ইত্যাদি। বিল ঝিল অঞ্চলেই এ ধরনের গানের প্রভাব বেশি করে পড়ে। তাছাড়া, ষড়ঋতুর বিচিত্র প্রভাব পূর্ব ময়মনসিংহের নরনারী নির্বিশেষে সবাইকে কাব্যিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছে-যার ফলে আবালবৃদ্ধবনিতা ভাবুক হয়ে ওঠেছে, হয়েছে শিল্প ও সংস্কৃতি চেতনার স্বভাবজ অধিকারী ।

কবি রওশন ইজদানী ছিলেন এই অঞ্চলের লোকসাহিত্যের একজন যথার্থ উত্তরাধিকারী। তাঁর জীবন সম্পর্কে লেখক এম. ইয়াসিন বলেন: ‘‘কবি পল্লীর কাদা জল মাটিতে দাঁড়াইয়া মাটির মানুষের মাটির সুরে পল্লীর গান গাহিয়াছেন…মাটির মানুষের অন্তর দিয়া পল্লীকে ভালবাসিয়াছেন এবং মাটির মানুষের খোলা চোখে পল্লীকে নিরীক্ষণ করিয়াছেন। ইহাই তাঁহার সাহিত্যসাধনার নিজস্ব ধারাবৈশিষ্ট্য। এই ধারাই শেষে তাঁর ‘খাতামুন নবীঈন’ পল্লী কাব্যে রসুলুল্লাহ’র পবিত্র জীবনালেখ্য চিত্রণে পূর্ণতা লাভ করিয়াছে।’’

এরই ধারাবাহিকতায় চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন-আদমজী পুরস্কার প্রবর্তনের পর তিনিই প্রথম পুরস্কারটি পেয়েছেন। মৃত্যুর পূর্বে আন্তর্জাতিক খ্যাতিও এসেছে তাঁর জীবনে।

পল্লীকবি বলে পল্লীই তাঁর একমাত্র আবাসস্থল ছিল, এমন নয়। শহুরে সমাজের কাছে তিনি পল্লীকে নিয়ে গেছেন তার সকল গ্রাম্য আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যসহ, আপন মর্যাদা এতোটুকু না খুইয়ে। এইখানেই তাঁর সাহস এবং কৃতিত্ব। তাঁর গ্রামের লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ছোট বেলায় তিনি নাকি খুব ভীতু প্রকৃতির ছিলেন। কিন্তু সাহিত্যে তিনি ছিলেন অকুতোভয়।

পল্লীর জন্য তাঁর এই অকুতোভয়তার প্রমাণ মেলে মৃত্যুর মাত্র বছর দেড়েক আগে আঠারোবাড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ে তাঁকে প্রধান অতিথি করে অনুষ্ঠিত সাহিত্যসভায় তিনি যে লিখিত ভাষণটি দিয়েছিলেন, তাতে। ভাষণটিতে তাঁর যে দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে, এতে তাঁকে সহজে আবিষ্কার করা যায়, চেনা যায়। তাঁর জীবনে এই ভাষণটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। অত্যন্ত অসুস্থ ছিলেন তিনি সে সময়। কিন্তু তবু সাত মাইল পথ মাড়িয়ে সে সভায় যোগ দিতে তিনি দ্বিধা করেন নি। স্কুলের ছাত্ররা তাঁকে তোরণ সাজিয়ে বরণ করেছিল। পল্লী অঞ্চলে সেই সময়ে এ ঘটনা বিশাল ব্যাপার ছিল। তাঁর মানসিকতা এবং সেই সময়ের অবস্থা সম্পর্কে একটা সম্যক ধারনা পাবার জন্যে আঠারোবাড়ি হাই স্কুলের তৎকালীন সহকারী শিক্ষক ও বন্ধু আবু ফাতেমা মুহাম্মদ ইসহাককে লেখা তাঁর পত্র এবং সভায় প্রদত্ত তাঁর ভাষণের অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করা হলো।

Bidyaballav

Via Atharabari

Mymensingh

3-2-1966

প্রিয় ইসহাক সাব,

তছলিমবাদ-আপনার পত্রটি গতকাল পেয়েছি। সংবাদ শুনে খুশী হলাম। জনাব চৌধুরী সাবকে আমার ছালাম জানিয়ে তাঁকে তশরিফ আনতে পত্র লিখুন। এখন আমার সম্বন্ধে বলছি। আমি বর্তমানে যে হালে আছি মনে হয় আল্লার মেহেরবানী থাকলে রিকশায় আসতে পারব। হাঁটার সামর্থ্য নেই। আগামী বুধবার তারিখ দিন। আমি সকালের দিকে রিকশার চেষ্টা নিব-যাতে বারটার পূর্বে আপনাদের স্কুলে পৌঁছতে পারি এবং সন্ধ্যার প্রাক্কালে আবার বাড়ীতে ফিরতে পারি। কোথাও রাত্রি যাপনে আমার বিশেষ অসুবিধা আছে, অবশ্যই দিনে দিনে বাড়ী ফিরতে চাই।

এখন আমার বর্তমান শারীরিক হাল শুনুন : আমি পূর্ববৎ এখনও বাতে ও আভ্যন্তরীণ দুর্বলতায় জব্দ-ভিতরে থর থর ভাব-হাত পা-ও অসাড় বোধ হয়, তখন কথাবার্তাও ঠিকমত বলতে পারি না। গত রমজান থেকে অপর একটি মারাত্মক উপসর্গ দেখা দিয়েছে, তা হল কিছু কিছু করে শ্বাসকষ্টের সৃষ্টি। একে প্রাথমিক অবস্থায়ই নিরাময় করা সম্ভব না হলে হয়তো জীবনের শেষ পর্যায়ে চরম কষ্টের মধ্যেই একদিন জীবন সন্ধ্যায় মৃত্যুর পেয়ালা পান করতে হবে। …আমার কাছে লেখা বিশেষ কিছু প্রত্যাশা করবেন না -খুব অচল ও অক্ষম। এ চিঠিটা দু’বারে লিখছি। লিখতে লিখতে হঠাৎ ভিতরটা এত দুর্বল হয়ে গেল যে, তখন বাধ্য হয়ে কলম ছেড়ে দিলাম। এখন রাত্রি ১০টা, আবার বাকী অংশ লিখছি। এইতো অবস্থা। এর মধ্যে Society for Asan Folklore and Folklore Institute, Indiana University, Bloomington, Indiana, USA Asian কর্তৃক যে Folklore Conference অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সামনের জুনে ২১ থেকে ২৫ তারিখ পর্য্যন্ত, তাতে পাকিস্তানী Folklore সম্বন্ধে প্রবন্ধ পাঠের জন্য Indiana University – স্থিত এর Executive Board-এর তরফ থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, কিন্তু আমিতো এখন-তখনের মরা; এ আমন্ত্রণ রক্ষা করা সম্ভব নয়। এ অক্ষমতা জানিয়েও বিভিন্ন স্থানে পত্র লিখে লিখে হয়রান হয়ে গেছি। আর এক ঝামেলায় জড়িয়ে গেছি, অক্ষম বলেও বাঁচতে পারছি না। গ্রামের প্রাইমারী স্কুলটির সঙ্গে একটি নতুন জুনিয়ার হাই স্কুল করা হচ্ছে। এর পৃষ্ঠপোষকতা করতে হচ্ছে… এর মঞ্জুরী আমাকে এনে দিতে হবে ইত্যাদি গ্রামবাসীদের দাবী। সকলের প্রতি প্রীতি, শ্রদ্ধা ও ছালাম ।

আরজ গোজার

রওশন ইজদানী

ভাষণের একাংশঃ

‘আমার ইচ্ছা ছিল ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র অঞ্চলকে আমার জীবনব্যাপী সাধনায় আরও মহত্তর মহিমায় ও মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করব এবং সেমতে আমার সংকল্প ছিল:

(ক) ময়মনসিংহের পল্লী কবিদের জীবনী সংগ্রহ ও গ্রন্থ প্রকাশ;

(খ) তাঁদের গীতিগানের একটা পূর্ণাঙ্গ সংকলন প্রকাশ-সংগৃহীত হলে তা বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশের বন্দোবস্ত করা যেত;

(গ) আমার ‘মোমেনশাহীর লোক সাহিত্য’ ও উল্লিখিত বিভিন্ন ধারায় কতিপয় সংগ্রহ প্রকাশের ব্যবস্থা করা;

(ঘ) পল্লী এলাকার কবি-সাহিত্যিকদের রচনা নিয়ে একটি নিভাঁজ পল্লী সাহিত্য বার্ষিকী প্রকাশ করা;

(ঙ) সর্বোপরি, মোমেনশাহী জেলার সমস্ত পল্লী কবিদেরকে একটি পরিমÐলে সম্মিলিত করা এবং নতুন পল্লী কবিদের পথে তুলে দেওয়া ও উৎসাহিত করা।’

কবি’র এই স্বপ্ন কতোটা বাস্তবায়িত হয়েছে, একটু খোঁজ-খবর করলে তা জানা যাবে। এর আলোকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিয়ে কবি’র স্বপ্ন পূরণে কাজ করেই কবিকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে।’                             চলমান

 

স্বপন পাল- কবি ও প্রাবন্ধিক। জন্ম ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ৯ জানুয়ারি। পিতা স্বৰ্গীয় সন্তোষ কুমার পাল, মাতা নির্মলা বাসিনী পাল। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর স্বপন পাল-এর লেখালেখি শুরু ছাত্রজীবন থেকেই। ছাত্রজীবনে ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা ‘বজ্র’র নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সক্রিয় ছিলেন ছাত্র সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বই প্রবন্ধ ও জীবনী: ডিরোজিও : মুক্তচিন্তার পথিকৃৎ, রবীন্দ্রনাথ গান্ধী সুভাষ পারস্পরিকতা, নো নেশন ও রবীন্দ্রনাথের রাজনীতি, অক্টোবর বিপ্লব ও রবীন্দ্রনাথ, আনন্দমোহন বসু : ইতিহাসের অপ্রকাশিত অধ্যায় [মৃন্ময় পাল সংলাপ-এর সঙ্গে যৌথভাবে] সামাজিক শক্তির বিকাশ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ [সংকলন] নজরুল: এ লিভিং লিঙ্ক, কালান্তরের পথনির্মাতা-কাদম্বিনী, রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ: কাছে ও দূরে। উপন্যাস ময়মনসিংহ জংশন। কবিতা জীবনটাকে ছোঁব বলে, আমাকে উপেক্ষা করো এমন শক্তি কোথায়। বর্তমানে একটি বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
Tags: প্রবন্ধরওশন ইজদানীস্বপন পাল
Previous Post

প্রবন্ধ।। সৃষ্টিশীলতার নৈতিকতা এবং সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।। আল মাকসুদ

Chatal

Chatal

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • About
  • Advertise
  • Privacy & Policy
  • Contact
বাংলামটর, ঢাকা-১০০০, বাংলাদেশ।
ই-মেইল: [email protected]

© 2021 Chatalbd - Design & Developed By Developer Rejwan.

No Result
View All Result
  • হোম
  • পরিচিতি
  • প্রবন্ধ
  • কবিতা
  • গল্প
  • সাক্ষাৎকার
  • বই আলোচনা
  • আলোকচিত্র
  • প্রতিবেদন
  • অনুবাদ সাহিত্য
  • বিশেষ আয়োজন
  • বিবিধ
  • কবি-লেখকবৃন্দ

© 2021 Chatalbd - Design & Developed By Developer Rejwan.

Welcome Back!

Login to your account below

Forgotten Password?

Retrieve your password

Please enter your username or email address to reset your password.

Log In